গল্পের শহর ;
ভালোবাসা ত্রিভুজ
পর্ব ১: পরিচয়
ঢাকা শহরের কোলাহলে মিশে থাকা হাজারো মুখের ভিড়ে কিছু মুখ অদ্ভুতভাবে আমাদের জীবনে এসে স্থায়ী হয়ে যায়। যেমন রাফি আর তামিম—দুই বন্ধু, দুইটা বিপরীত চরিত্র, কিন্তু একে অপরের পরিপূরক।
রাফি জন্ম থেকেই একটু নীরব প্রকৃতির ছেলে। তার চোখে সব সময় একটা গম্ভীর, চিন্তিত অভিব্যক্তি খেলে বেড়াত। মুখে কম কথা, বইয়ের পৃষ্ঠায় বেশি সময়। ধানমন্ডির এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সে। মা-বাবা দুজনেই শিক্ষক, তাই রাফির বেড়ে ওঠা হয়েছিল কঠোর শাসনের ছায়ায়।
অন্যদিকে তামিম যেন এক ঝড়। সে যেখানে যায়, আড্ডা জমে, হাসি ছড়িয়ে পড়ে। উচ্চবিত্ত ঘরের একমাত্র ছেলে। গুলশানের এক আধুনিক পরিবারে বড় হওয়া তামিমের জন্য জীবনটা বরাবরই একটু সহজ ছিল। কিন্তু তার ভেতরে একটা গভীরতা ছিল, যেটা সে খুব সহজে প্রকাশ করত না।
দুই বন্ধু একসাথে স্কুলে পড়ে না, তবে কলেজ জীবন থেকে তাদের বন্ধুত্বের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে ভর্তি পরীক্ষায় টিকেও তারা একই বিভাগে চলে আসে—বাংলা বিভাগ। একাডেমিক ক্যাম্পাসের ঘাসে বসে বিকেল কাটানো, টিএসসির চায়ের কাপ, মিলন চত্বরের নিরবতা—সব জায়গাতেই তাদের জোড়া দেখা যেত।
তবে এই গল্পের বাঁক নেয় যেদিন মীম তাদের জীবনে প্রবেশ করে।
মীম প্রথমদিন ক্লাসে এসেই যেন একটা হালকা ঝড় বইয়ে দেয়। শাড়ি পরা মেয়েটার চোখে অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস ছিল। তার উচ্চারণে, চালচলনে ছিল পরিশীলিত একটা আভিজাত্য, কিন্তু মনটা ছিল একদম সহজ, সহজাত, বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশে যাওয়ার মতো উষ্ণ।
তামিম প্রথম থেকেই ওকে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
—"দোস্ত, নতুন মেয়েটা দেখলি? নামটা কী যেন... মীম না?"
রাফি হালকা হেসে বলে, "হুম, শুনলাম। গাজীপুর থেকে এসেছে, হলে থাকে।"
—"বাহ! গাজীপুর তো দূর... এমন মেয়ে হলে থেকে পড়ে মানে সিরিয়াস টাইপ মনে হয়।"
রাফি কিছু না বলে একটা বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ রাখে। কিন্তু তার মনও ঠিক তখনই মীম নামটা গেঁথে নিচ্ছে নিজের ভেতরে।
কিছুদিনের মধ্যেই পরিচয় হয়। ক্লাসের একটা গ্রুপ প্রেজেন্টেশনে রাফি, তামিম আর মীম এক গ্রুপে পড়ে যায়। কাজ করতে করতে, কথা বলতে বলতে একটা সেতু তৈরি হয়—রাফির নীরবতা, তামিমের প্রাণখোলা আড্ডা আর মীমের মাঝারি মেজাজ মিলে এক অদ্ভুত সঙ্গতি তৈরি করে।
প্রেজেন্টেশনের দিন, মীম যখন পুরো ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে তার অংশ উপস্থাপন করে, তখন রাফির মনে হয়—এই মেয়েটার মধ্যে কিছু আছে। এমন কিছু, যেটা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না... কেবল অনুভব করা যায়।
সেদিন বিকেলে তামিম বলে,
—"দোস্ত, মেয়েটা অনেক স্মার্ট, না?"
রাফি মাথা নাড়ায়, ধীরে বলে, "হুম, খুব আত্মবিশ্বাসী।"
তামিম হেসে বলে, "আর সুন্দরও, না?"
রাফি এবার কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে সামনের লাল গোধূলির দিকে।
মীম তখনো জানে না—তার জীবনের গল্প লিখে ফেলছে দুটো হৃদয়। দুটো বন্ধু, যারা একদিন হয়তো একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াবে ভালোবাসার এক অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে।
ভালোবাসা ত্রিভুজ
পর্ব ২: বন্ধুত্বের রঙ
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ছয় মাস এক অদ্ভুত গতিতে কেটে যাচ্ছিল। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়াল, গ্রুপ প্রেজেন্টেশন—সবকিছুর মধ্যেও সময় যেন উড়ে চলেছিল রঙিন পাখির মতো।
এই সময়েই মীম, রাফি আর তামিম—তিনজনের বন্ধুত্ব এমন জায়গায় পৌঁছে গেল যেখানে তারা কেউ কাউকে ছাড়া ভাবতেই পারত না।
একদিন ক্লাস শেষে তারা তিনজন বসেছিল ক্যাম্পাসের পেছনের বটগাছটার নিচে। সন্ধ্যার আলো ফুরিয়ে যাচ্ছিল, পাখিরা ডানায় ভর করে বাড়ি ফিরছিল।
তামিম হাসতে হাসতে বলল,
—"এই মীম, তোর মনে হয় না, রাফি আসলে মোনালিসার আত্মীয়?"
মীম অবাক হয়ে তাকায়,
—"মানে?"
—"মানে রে বোকা, ওর মুখেও সেই একই রহস্যময় হাসি! কই হাসি? না হাসি?"
রাফি হালকা হাসে, কিছু না বলে। মীমও হেসে ফেলে।
—"তোর কথার জবাব নেই।"
তামিমের বলা কথাগুলো ছিল হালকা, মজার, কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল এক অদৃশ্য দখলের অনুভূতি। সে বুঝতে পারছিল, রাফির ভেতর কিছু একটা চলছে—যেটা মুখে বলছে না, কিন্তু চোখে টের পাওয়া যায়।
রাফি কিন্তু নিজেও সেটা স্বীকার করতে ভয় পায়। সে জানে, এই যে প্রতিদিন মীমের অপেক্ষায় থাকা, তার এক টুকরো হাসি দেখে মন ভালো হয়ে যাওয়া, তার চোখের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাওয়া—এসব কেবল বন্ধুত্ব নয়।
কিন্তু এই অনুভূতি নিয়ে সে কিছু বলতে পারে না।
সে ভয় পায়।
তামিমকে হারানোর ভয়, মীমকে হারানোর ভয়, নিজেকে হারানোর ভয়।
অন্যদিকে তামিম ঠিক করেছিল একদিন না একদিন মীমকে সে বলবেই তার মনের কথা।
তার ধারণা ছিল—সে যেমন প্রাণবন্ত, যেমন আত্মবিশ্বাসী—মীম তার সাথেই মানানসই। রাফিকে সে কখনোই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে না, বরং ভাবে—ও তো এমনিই, কারো প্রেমে পড়বে না।
একদিন একটা বৃষ্টির বিকেলে, মীম হঠাৎ রাফিকে জিজ্ঞেস করল,
—"রাফি, তুই কীভাবে এত চুপচাপ থাকতে পারিস?"
রাফি কাঁধ ঝাঁকায়,
—"সবার স্বভাব আলাদা। আমি বেশি বলার মানুষ না।"
মীম একটু হাসে। তার চোখে একটা মৃদু কৌতূহল,
—"তোর চোখে অনেক কিছু জমে থাকে রে... কখনো ভাবিস মুখে বলবি?"
রাফি চমকে যায়।
সে ভাবে, ‘ও কী বুঝে ফেলল?’
কিন্তু না, মীম কিছুই বোঝে না। সে নির্দ্বিধায় বলে,
—"তুই আমাদের মাঝে সবচেয়ে পরিণত, জানিস?"
রাফির ঠোঁটে তখন সেই মোনালিসার মতো হাসি খেলে যায়।
চুপচাপ, নীরব, কিন্তু গভীর।
সেদিন থেকেই বন্ধুত্বের রঙে অন্য এক আবেশ মিশে যেতে শুরু করে।
যেখানে রঙ কেবল লাল, নীল, হলুদ না—সেখানে আবেগ, আকর্ষণ, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগ একসাথে আঁকা হতে থাকে।
তবে এই রঙগুলো সবাই দেখে না। কেউ দেখে ভেতর দিয়ে, কেউ বুঝে চোখ দিয়ে, আর কেউ থাকে অন্ধকারে—চোখে আলো থাকলেও হৃদয়ের জানালা বন্ধ রেখে।
ভালোবাসা ত্রিভুজ
পর্ব ৩: না বলা ভালোবাসা
রাফি জানে, সে মীমকে ভালোবেসে ফেলেছে।
কিন্তু সে এটাও জানে—এই ভালোবাসার কথা বলা মানেই একটা বন্ধুত্বের সমাপ্তি ডেকে আনা, একটা সম্পর্কের ভারসাম্য ভেঙে ফেলা, এমন কিছু দাবি করা—যেটা তার প্রাপ্য নয়।
প্রতিদিন মীমকে দেখে তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত ঢেউ ওঠে।
মীমের হাসি, তার সরল প্রশ্ন, হঠাৎ হঠাৎ হাত ছুঁয়ে বলা “রাফি, তুই তো সব জানিস”—সবকিছু যেন রাফির হৃদয়ের গোপন কোনায় গেঁথে থাকে।
কিন্তু রাফি জানে, মীম ওকে "বিশেষভাবে" ভাবে না।
সে তামিমের মত সাহসী না, উচ্চারণে সাবলীল না, গলার স্বরে আস্থা নেই।
সে বিশ্বাস করে, “ভালোবাসা যদি নিঃশব্দে থাকে, তবে সেটা আর কাউকে কষ্টও দেয় না।”
একদিন টিএসসির চায়ের দোকানে তামিম ও মীম কিছুটা দূরে বসে গল্প করছিল। রাফি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা চায়ের কাপ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তার চোখ মীমের মুখে আটকে আছে—এক মুহূর্তের জন্য হলেও, সে যেন চায় সময় থেমে যাক।
—"রাফি, চা খাবি না?" তামিম ডেকে তোলে তাকে বাস্তবতায়।
সে একটু চমকে উঠে হাসে, "হ্যাঁ, হ্যাঁ খাচ্ছি তো।"
তামিম ওর পাশে এসে দাঁড়ায়।
—"দোস্ত, একটা কথা বলি?"
রাফি তাকায় ওর দিকে।
—"বল।"
—"আমি ঠিক করেছি, মীমকে বলব আমি ওকে পছন্দ করি।"
সেই মুহূর্তে রাফির ভেতরের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায়।
যেন কেউ তার বুকের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে, নিঃশব্দে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে।
সে ঠোঁট ভিজিয়ে শান্ত গলায় বলে,
—"তুই নিশ্চিত?"
—"হ্যাঁ। এতদিন তো ভাবছিলাম, এখন মনে হচ্ছে আর দেরি করা ঠিক হবে না।"
রাফি মাথা নাড়ায়।
—"ঠিক আছে। বল।"
তামিম আনন্দে বলে,
—"তুই পাশে থাকবি তো, রে? আমি জানি তুই ছাড়া আমার কোনো পরিকল্পনাই জমে না।"
রাফি কৃত্রিম হাসিতে মুখ ঢাকে।
—"আমি তো থাকবই।"
মনে মনে রাফি ভাবে,
“মনের কথা বলার অধিকার কি আমার ছিল না? নাকি তোর জন্য আমি সব ছেড়ে দিতেই শিখেছি, তামিম?”
পরদিন ক্লাস শেষে তামিম আর মীমকে ক্যাম্পাসে হাঁটতে দেখে রাফি একা ফিরে যায়। সে জানে, আজ তামিম বলবে তার মনের কথা। আজ হয়তো অনেক কিছু বদলে যাবে।
হোস্টেলের রুমে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ে রাফি। চোখ বন্ধ করে।
কিন্তু মনের দরজায় একটানা ধাক্কা দিচ্ছে মীমের কণ্ঠস্বর, হাসি, চোখ... আর তামিমের বলা সেই কথাগুলো।
রাফি মনে মনে বলে,
"আমি তোকে ভালোবাসি, মীম। কিন্তু তুই তা কখনো জানবি না। কারণ আমার ভালোবাসা কেবল অনুভবের জন্য, দাবি করার জন্য নয়।"
এই পর্বে, প্রথমবার রাফি উপলব্ধি করে—ভালোবাসা মানেই পাওয়ার খেলা নয়। কিছু ভালোবাসা শুধু বুকের ভেতর থাকে, নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থে।
ভালোবাসা ত্রিভুজ
পর্ব ৪: তামিমের স্বীকারোক্তি
আকাশ সেদিন ছিল মেঘলা। ধোঁয়াশা, ভেজা বাতাস, আর বিকেলের নরম রোদ মিলে একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছিল পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে।
তামিম সেদিন নিজেকে যেন অন্যরকম লাগছিল। সে আয়নায় তাকিয়ে একাধিকবার নিজের চুল ঠিক করেছিল, জুতোটা মুছেছিল, এমনকি নতুন পারফিউমও দিয়েছে—যেটা সে সাধারণত ব্যবহার করে না। তার মনে হচ্ছিল, এই দিনটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
মীমকে সে ডেকেছিল ছুটির পর ক্যাম্পাসের পেছনের লেকে। ওরা প্রায়ই সেখানে বসে গল্প করত, তাই আলাদা করে কিছু বোঝার সুযোগ ছিল না।
মীম আসতেই তামিম একটু সঙ্কোচে পড়ে গেল। সাধারণত সে খুব সাবলীল, কিন্তু আজ বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল। মীম সাদা ওড়না মাথায় দিয়েছে, চোখে হালকা কাজল—তামিম যেন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই চায়।
—"তামিম, বল। এমন গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে বসে আছিস কেন?"
তামিম একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয়।
—"মীম, আজ আমি তোকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। খুব সিরিয়াস কথা।"
মীম একটু থমকে যায়। তার চোখে একটা কৌতূহল দেখা দেয়।
—"তুই তো জানিস, আমি সাধারণত যা ভাবি, সেটা বলেই ফেলি। কিন্তু এই কথা অনেকদিন ধরে মনে লুকিয়ে রেখেছি।
আমি তোকে পছন্দ করি, মীম। না না… এই পছন্দটা বন্ধু হিসেবে না। অন্যরকম।
আমি তোকে ভালোবাসি। খুব গভীরভাবে।
তুই আমার জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষ হতে পারিস, যদি তুই চাস।"
তামিম বলেই ফেলে সবকিছু। চোখে ছিল একরাশ বিশ্বাস, ঠোঁটে হালকা কাঁপুনি।
মীম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। তারপর ধীরে বলে,
—"তামিম, আমি তোকে অসম্ভব পছন্দ করি।
তোর হাসি, তোর বন্ধুত্ব, তোর প্রাণবন্ততা… সবকিছুই।
কিন্তু… আমি আসলে এখনও জানি না আমি তোকে ঠিক সেইভাবে ভালোবাসি কিনা।
আমি কনফিউজড, তামিম।
তুই তো জানিস, সম্পর্ক মানেই শুধু ভালো লাগা না—আরো অনেক কিছু লাগে, একধরনের মানসিক প্রস্তুতি। আমি কি সেই জায়গায় আছি, সেটা নিজেই জানি না এখনো।"
তামিম চুপচাপ শুনে যায়। মীম কোনো "না" বলে না, কিন্তু কোনো "হ্যাঁ"-ও না।
তামিম চেষ্টা করে হেসে বলতে,
—"আমি তোর উত্তর চাই এখনই না, মীম। তুই সময় নিয়ে ভাব। আমি অপেক্ষা করব।"
মীম মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।
সেদিন বাসায় ফেরার পথে তামিমের মনের ভেতর ছিল এক অদ্ভুত খালি ভাব। সে জানে না, মীম সময় নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে, কিন্তু সে এই প্রথম বুঝতে পারে—ভালোবাসা অনেক সময় উত্তরের চেয়েও প্রশ্নে বেশি ঘনীভূত হয়।
তামিম জানে না, ঠিক এই মুহূর্তে রাফি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির কোনায় বসে, বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে কী যেন পড়ার চেষ্টা করছে, অথচ তার চোখের পাতার নিচে আটকে আছে একটা নাম—মীম।
আর মনের গহীনে একটা প্রশ্ন—
“সে কি ওকে হ্যাঁ বলবে?”
ভালোবাসা ত্রিভুজ
পর্ব ৫: মীমের দ্বন্দ্ব
রাতে হলে ফিরে মীম জানালার পাশে বসে ছিল। জানালার ওপাশে আধো আলো-আঁধারিতে দেখা যাচ্ছিল ক্যাম্পাসের ছায়াময় গাছপালা। বৃষ্টির পরের সন্ধ্যায় বাতাসে একটা ঠাণ্ডা সতেজতা। কিন্তু মীমের মন যেন ভারী হয়ে আছে।
তামিমের প্রস্তাবটা হঠাৎ করে নয়, কিন্তু অপ্রস্তুতভাবে এসেছিল তার কাছে।
তামিম তাকে ভালোবাসে—এইটা সে বুঝেছিল আগেই। কিন্তু তামিম বলার পর ব্যাপারটা আরও বাস্তব হয়ে উঠল। কোনো কল্পনা বা ইঙ্গিত নয়, এবার সত্যিই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সে ভাবছিল,
“তামিমকে আমি পছন্দ করি। ও দারুণ বন্ধু, যত্ন করে, হাসাতে জানে, পাশে থাকে। কিন্তু ভালোবাসি? জানি না। আমি কেন এত দ্বিধায়?”
তার মনের কোণে বারবার ভেসে উঠছে রাফির মুখ।
রাফির নিঃশব্দ হাসি, চোখের গভীর দৃষ্টি, কথা না বললেও বলা হয়ে যাওয়া অনুভবগুলো।
একদিন, মীম অসুস্থ হয়ে গেলে রাফিই প্রথম হলের সামনে গিয়ে তার জন্য ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিছু বলেনি, কেবল বলেছিল,
—"ওষুধটা সময়মতো খেয়ে নিস।"
সেই ছোট্ট, নির্ভরতার মতো শব্দগুলো আজও মীম ভুলতে পারেনি।
রাত বাড়ে। রুমমেটরা ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু মীমের চোখে ঘুম নেই।
তার মনে হচ্ছে, দুটো রাস্তা। একদিকে তামিম—উজ্জ্বল, সাহসী, ছায়ার মতো সঙ্গী হতে চাওয়া একটা মানুষ।
আর অন্যদিকে রাফি—নিরব, গভীর, অপ্রকাশিত কিন্তু অনুভূত এক ভালোবাসা।
যে ভালোবাসা হয়তো বলা হয়নি, কিন্তু অনুভব করা গেছে প্রতিটা আচরণে।
পরদিন ক্লাসে গিয়ে মীম রাফিকে দেখে।
রাফি ওকে দেখে চোখ সরিয়ে নেয়, কিন্তু মীম লক্ষ্য করে—আজ তার মুখটা যেন আরও গম্ভীর, চোখের নিচে হালকা ক্লান্তির ছাপ।
তামিমও হাসিখুশি থাকার ভান করছে। কিন্তু মীম জানে, ও অপেক্ষায় আছে।
বিরতির সময় তামিম বলে,
—"মীম, আজ একটু বাইরে যাবি? তোর উত্তরটা জানার ইচ্ছা হচ্ছে খুব।"
মীম হালকা হাসে,
—"তুই আমাকে আরেকটু সময় দিবি? আমার দরকার…"
তামিম চুপ হয়ে যায়। তার চোখে একটু হতাশার ছায়া।
সে মাথা নাড়ে,
—"ঠিক আছে। সময় নে।"
রাফি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শুনে ফেলে কথাগুলো। সে কিছু বলে না, কিন্তু একটা চাপা স্বস্তি যেন বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে।
তবে মীম নিজেও জানে না—সে কী চায়।
সে জানে না, ভালোবাসা কি সাহসিকতায় জন্ম নেয়, নাকি নীরবতার গভীরতায়?
সেই রাতে ডায়েরির পাতায় সে লিখে ফেলে,
“তামিম আমাকে ভালোবাসে।
রাফি আমাকে বোঝে।
আমি কী চায়? আমি কার কাছে নিজের সবচেয়ে সত্যিকারের রূপটা দেখাতে পারি?”
তার উত্তর এখনো সে খুঁজে পায়নি।
কিন্তু সে জানে—এই প্রশ্নটার উত্তর একদিন না একদিন তাকে দিতেই হবে।
ভালোবাসা ত্রিভুজ
পর্ব ৬: অজানার প্রস্তাব
পর্বের শুরুতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ও বন্ধুত্বের মাঝে দিন গুলো দ্রুত কেটে যাচ্ছে। কিন্তু রাফির মন যেন দিন দিন ভারাক্রান্ত হচ্ছে। সে মুখে হাসি রাখলেও ভিতরে লুকিয়ে আছে এক অজানা দুঃখ।
একদিন সন্ধ্যায়, ক্লাস শেষে তামিম মীমকে ডেকে বলে,
— “মীম, আমি একটা কথা বলতে চাই, যেটা হয়তো আমাদের জীবনের জন্য খুব বড় হতে পারে।”
মীম কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
— “কি কথা, তামিম? বল তো।”
তামিম এক গভীর শ্বাস নেয়,
— “আমার প্যারেন্টস অনেকদিন ধরেই চাচ্ছে আমি আমার ক্যারিয়ার বাড়ানোর জন্য দেশের বাইরে যাই। একটা সুযোগ এসেছে, আমাকে বিদেশে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে পাঠানোর জন্য। আমি যাচ্ছি বিদেশে।”
মীম চোখ বড় করে চেয়ে থাকে।
— “তুই? বিদেশে? কতদিন? কবে যাবিস?”
— “৬ মাসের জন্য। তবে… ওখানে গিয়ে আমি চাই তুই আমার সাথে থাকিস। আমার সাথে যদি তুই একসাথে যাও, তাহলে সেটা আমার জন্য অনেক বড় সাহসের কাজ হবে।”
মীম হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
— “আমি? আমার কী হবে? আমি তো...?”
তামিম মাথা নাড়িয়ে হাসে,
— “আমি জানি তুই পড়াশোনায় ভালো করিস, কিন্তু আমার চাই আমি ওখানে থাকতে চাই তোমাকে। আমি চাই তুমি আমার পাশে থাকিস, আমরা একসাথে নতুন একটা জীবন শুরু করি।”
এই কথা শুনে মীমের মনে ভাঙা ঘর যেন একটু ধীরে ধীরে গেঁথে যায়। তার মাথায় একের পর এক প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। রাফি? রাফির প্রতি তার মনের আবেগ? এতদিনের বন্ধুত্বের কি হবে?
রাফি দূর থেকে দেখে যায় মীম ও তামিমের এই আলাপ। তার বুকের ভেতর ঢেউ উঠে, আর সে বুঝতে পারে সে আর একেবারে চুপ থাকতে পারবে না।
সেদিন রাতেই রাফি সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার মনের কথাগুলো মীমকে জানাবে, আর সে চাইবে তার ভালোবাসা তার জীবনে নতুন আলো নিয়ে আসুক—চাইলে না চাইলেও।
চলুন, এখনই চলি ভালোবাসা ত্রিভুজ এর পর্ব ৭ এ — যেখানে রাফি শেষমেষ নিজের মনের কথা মীমকে খুলে বলবে, আর তামিমের প্রস্তাব নিয়ে মীমের ভাবনার দোলাচল আরও গভীর হবে।
ভালোবাসা ত্রিভুজ
পর্ব ৭: সত্যের মুখোমুখি
পরদিন বিকেলে, ক্যাম্পাসের শীতল ছায়ায় বসে রাফি একটা সাহসের নিঃশ্বাস নিয়ে মীমের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার হাতে এক কাপ চা, মুখে অস্থির একটা হাসি। মীম চোখ বড় করে তাকায়, বুঝতে পারে—আজ কিছু আলাদা হতে চলেছে।
রাফি বলল,
— "মীম, একটা কথা অনেকদিন ধরে আমার মুখে আসতে চাচ্ছিলো, কিন্তু সাহস হয়নি। এখন আর আরাম লাগে না সেটা লুকিয়ে রাখতে।"
মীম চুপ করে রাফির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মন এখনো তামিমের কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু রাফির কথা শোনার আগ্রহও কম নেই।
রাফি আবার বলল,
— "আমি তোকে ভালোবাসি, মীম। আমার ভালোবাসাটা নিঃশব্দ, চুপচাপ, কিন্তু সত্য। আমি জানি তুই হয়তো আমাকে ওইভাবে ভাবিস না, কিন্তু আমার জীবনে তুই একটা আলোর মতো—যে আলো ছুঁয়ে যায় আমার অন্ধকার মনে।"
মীম হঠাৎ বুকে একটা অজানা অনুভূতি অনুভব করল—আবেগের ঘূর্ণি, কষ্ট আর অদ্ভুত এক কোমলতার মিশ্রণ। সে চুপচাপ রাফির কথা শুনে, কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু শব্দ বের হলো না।
তখনই তামিমের বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব আবার তার মনে জেগে উঠে।
কী করবে সে? কার দিকে তার মন যাবে? রাফির নিঃশব্দ ভালোবাসা নাকি তামিমের সাহসী প্রস্তাব?
মীম গা ঢাকা দিয়ে বলতে চায়, "আমাকে সময় দাও।"
রাফির চোখে কিছুটা আশার ঝিলিক দেখতে পেল সে।
সেদিন থেকে মীমের মন জেগে ওঠে নতুন করে—ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর জীবনের জটিলতাগুলোকে নিয়ে। সে বুঝতে শুরু করে, ভালোবাসা কোনো সরল গল্প নয়, বরং সেটা নানা রঙে রঙিন এক মিশ্রণ।
দ্বিতীয় পর্ব দেখতে লিংকে ক্লিক করুন
https://supervehiclesss.blogspot.com/2025/06/blog-post_96.html
📖
No comments:
Post a Comment