গল্পের সম্ভার ;

📖 সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা

✦ ১ম পর্ব : 

নতুন ঠিকানায়, নতুন গল্পে

মেহরিন ক্লাস নাইনে নতুন ভর্তি হয়েছে শহরের বিখ্যাত ‘বিকাশ বিদ্যাপীঠ’ স্কুলে। ঢাকার ব্যস্ততা থেকে বাবা বদলি হয়ে মফস্বলে চলে আসার পর এই স্কুলটাই তার জন্য নতুন পৃথিবী। মেহরিন একটু চুপচাপ, বইপড়ুয়া মেয়ে—বন্ধুর থেকেও ডায়রি তার বেশি আপন।
প্রথম দিন- মেহরিন অনেক বেশি আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত ছিল।নতুন স্কুল নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু বান্ধবী। সবকিছু নিয়ে মেহরিন অনেক বেশি খুশি ছিল ।এসব চিন্তা করতে করতে   মেহরিন  স্কুলের গেটের সামনে ধাক্কা খায় একটা সাইকেলের সঙ্গে।মেহরিন পড়ে যায় ও ব্যথা পায়, আর খুবই বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। 
— "দেখেন না? লোকজনের ওপর সাইকেল উঠিয়ে দিচ্ছেন?" — বিরক্ত মেহরিন।
— "আর আপনি কি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন,  পাশে গিয়ে দাঁড়ান,  — ছেলেটা মুচকি হেসে বলে।
সে ছেলেটার নাম রুদ্র।
স্কুলের সবচেয়ে দুরন্ত আর খামখেয়ালি ছাত্র। সব শিক্ষক-শিক্ষিকা জানেন—ওর পেছনে বসলে কেউ পড়ালেখা শেখে না, হাসাহাসি আর দুষ্টুমিতে ব্যস্ত থাকে। তাদের আর পড়ালেখা হয় না। 
রুদ্র ক্লাসের একদম শেষ বেঞ্চে বসে। মেহরিন প্রথম দিন থেকেই প্রথম বেঞ্চে। কিন্তু টিফিন পিরিয়ডে, করিডোরে, লাইব্রেরির লাইনে—প্রায়ই মুখোমুখি হয় তাদের।রুদ্র তখন থেকেই মেহরিনকে বিরক্ত করা শুরু করে।কখনো  কাগজ ছুঁড়ে দেয়, কখনও পেনসিল চুরি করে নেয়, কখনও চুল টেনে বলে,
— “তুমি না ক্লাসের সবচেয়ে বোরিং মেয়ে!"
মেহরিন সারাদিন চুপচাপ ছিল। আগের রাতে মা-বাবার ঝগড়াটা আজও তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
স্কুলের লাইব্রেরিতে গিয়ে সে বসে পড়েছিল প্রিয় কোণটাতে, জানালার পাশে, যেখান থেকে আকাশটা দেখা যায়। চোখে জল চলে এসেছিল—অথচ কেউ তা দেখুক, তা সে চায় না।অনেকটা  লুকিয়ে ডাইরি লিখছিল ও কাঁদছিল। 
হঠাৎ রুদ্র দূর থেকে দেখে, লাইব্রেরীতে বসে মেহরিন কি যেন করছে।রুদ্র সামনে এগিয়ে এসে মেহরিনকে জিজ্ঞেস করল, কি করছো তুমি। মেহরিনের হঠাৎ  চোখ পড়ে যায় রুদ্রের  দিকে। রুদ্রও তার দিকে তাকিয়ে থাকে, রুদ্র দেখে মেহেরিনের চোখ ছল ছল করছে। মেহেরিনের চোখে পানি দেখে রুদ্র কেমন যেন নিরব হয়ে গিয়েছিল। মেহেরিনের প্রতি মায়া হল তার। কিছু একটা চিন্তা করে ওকে হাসানোর চেষ্টা করলো। 
— “তুমি কাঁদলে তোমার  এইচএসসি নম্বর কমে যাবে।”বললো রুদ্র। 
— “তুমি যাও তো... আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”বিরক্ত হলো মেহরিন। 
রুদ্র একটু নরম সুরে বলল,
— “তুমি জানো? যারা কাঁদতে জানে, তারা ভালোবাসতেও জানে।”
মেহরিন কোনো উত্তর দিল না। শুধু মাথা নিচু করে বসে রইল।
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর উঠে চলে গেল। পরের দিন ক্লাসে মেহরিন যখন একটু বাহিরে গিয়েছিলো সেই সুযোগে রুদ্র  একটা  চিঠি তার ব্যাগে রেখে দিল। 
ক্লাসে গণিতের স্যার  আসলো, মেহেরিন ক্লাস করার জন্য ব্যাগ থেকে যখনি খাতা বের করতে গেল , তখন ও খেয়াল করল ওর খাতার উপরে ভাঁজ করা একটা কাগজ। ক্লাসে স্যার থাকায় মেহেরিন তখন কাগজটি খুলে দেখেনি।
ক্লাস শেষে মেহেরিন লাইব্রেরীতে গিয়ে কাগজটি খুলে দেখলো।

✦ দ্বিতীয় পর্ব: 

*“প্রিয় বোরিং মেয়ে,
তোমার চোখে দুঃখ দেখলে আমার হাসি পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
আমি খামখেয়ালি হতে পারি, ডিস্টার্বিং হতে পারি,
কিন্তু কারও চোখে জল দেখতে পারি না... বিশেষ করে তোমার চোখে।
তোমার চুলে পেন্সিল ঢুকিয়ে দুষ্টুমি করি ঠিকই,
কিন্তু জানো? ওই মুহূর্তগুলোই আমার প্রিয়।
তুমি রেগে যাও, আমি হেসে যাই।
তুমি চুপ করে থাকো, আমি ভেতরে ভেতরে তোমার গল্প লিখি।
তুমি জানো না, তুমি আমার প্রতিদিনের সবচেয়ে সুন্দর ভুল।
— রুদ্র”**

---

মেহরিন চমকে ওঠে।
চিঠিটা কি সত্যি? এটা কি মজা, না...?
তার মন কাঁপতে থাকে। কিছু একটা ধীরে ধীরে গলতে থাকে তার ভেতরে।
রুদ্রের সেই চঞ্চল চোখের আড়ালে কি সত্যিই একটা স্পর্শকাতর হৃদয় লুকিয়ে আছে?
মেহেরিন ডায়রির নতুন পাতায় একটা প্রশ্ন লেখে—

“সে কি সত্যিই আমাকে একটু… পছন্দ করে?”

  চিঠিটা পেয়ে মেহরিন অনেক বেশি উচ্চশিত হয়। সেও রুদ্রকে ভালবাসতে শুরু করে।সে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে আর মনে মনে চিন্তা করে কেউ একজন মনে হয় ওকে অনেক বেশি ফলো করে।যেটা ভালো লাগতে শুরু করে মেহরিনের।পরের দিন মেহরিন স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হল। আজকে ও একটু সেজেগুজে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হল। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে একটু কাজল, এটুকুতেই ওকে যেন পরীর মত লাগছিল। স্কুলের গেট দিয়ে যখন ঢুকছে  তখন খুব লজ্জা পাচ্ছিল মেহেরিন। 

রুদ্র না আবার সামনে পড়ে যায় -মনে মনে ভাবলো মেহেরিন। 

মেহেরিন যখন ক্লাসে ঢুকবে ঠিক সেই মুহূর্তেই রুদ্র ক্লাস থেকে বের হচ্ছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দুজনের অনেক জোরে ধাক্কা লাগে, মেহেরিনের গায়ের উপর পড়ে যায় রুদ্র। 

এই প্রথম কোন মেয়ের শরীরের স্পর্শ  পেল রুদ্র। সেই স্পর্শ রুদ্রকে যেন পাগল করে দিচ্ছিল। আর তার সাথে তার সুন্দর সুন্দর গোলাপী ঠোঁটগুলো যেন তাজা একটি গোলাপ  ফুল হয়ে ফুটে আছে। 

এক্ষুনি আদর করতে মন চাইছিল। 

অপলক বৃষ্টিতে রুদ্র তাকিয়ে  আছে মেহেরিনের দিকে। 

ক্লাসের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে সেদিকে খেয়ালই নেই রুদ্রের। 

তখনই মেহেরিন ডেকে বলল -এই উঠো সবাই দেখছে আমাদেরকে " বলে রুদ্রকে একটা ধাক্কা দিল। 

রুদ্র তখনই তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ল আর মেহেরিনকে টেনে তুলল। 

""এই সরি সরি আমি ইচ্ছে করে ফেলে দিইনি;-বলল রুদ্র। 

মেহেরিন কিছু না বলেই ওর বেঞ্চে গিয়ে বসলো। 

ঐদিন একটিবারের জন্যও রুদ্র মেহেরিনের থেকে চোখ ফেরায় নি। পুরো ক্লাস জুড়ে শুধু মেহেরিনকে দেখেছে।

মেহরিন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করল। 

---

---

✦ তৃতীয় পর্ব:

স্কুলের সকালটা অন্য রকমভাবে শুরু হলো। আজ ক্লাস টেস্ট—বাংলা প্রথম পত্র।
মেহরিন যথারীতি প্রথম বেঞ্চে। সব উত্তর মুখস্থ, সব গুছানো।
রুদ্র? সে ক্লাসে ঢুকল পেছনের দরজা দিয়ে, হালকা ঘুমঘুম চোখে, হাতে একটা খালি খাতা।

কেউ একজন বলল — “রুদ্র, বই তো আনো নাই?”
— “বই তো পরীক্ষার জন্য লাগে না, উত্তর তো বন্ধুদের থেকে আসবে।” — বলে হেসে ফেলল রুদ্র। 

মেহরিন তাকিয়ে রইল চুপচাপ।

পরীক্ষা শুরু হলো। সবাই লিখছে। হঠাৎ মেহরিন টের পায়, পেছন থেকে রুদ্র তার বেঞ্চে কিছু গুঁজে দিয়েছে—একটা ছোট কাগজ।
ঠিক তখনই প্রবেশ করলেন বাংলা ম্যাডাম।

ম্যাডাম গম্ভীর হয়ে বললেন,
— “তুমি কী করছ রুদ্র?”
— “আমি... আমি…” — রুদ্র থমকে যায়।

ম্যাডাম তার খাতা খুলে দেখে একটা ভাঁজ করা কাগজ—
তাতে লেখা:

"প্রশ্ন ৩: প্রিয় ঋতুর বর্ণনা (সৃজনশীল  প্রশ্ন)"
আর নীচে লেখা মেহরিন-এর হাতের লেখায় সাজানো উত্তরের সারাংশ!

ম্যাডাম চিৎকার করে উঠলেন,
— “তুমি টুকলি করছ? তো বড় সাহস কই পেল রুদ্র?”
রুদ্র কিছু বলে না।

পুরো ক্লাস চুপচাপ।

তখন হঠাৎ মেহরিন দাঁড়িয়ে পড়ে।
নির্ভীক কণ্ঠে বলে,
— “স্যার, ওটা আমি দিয়েছি। ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বিশ্বাস করেছিলাম ও কপি করবে না।”

ম্যাডাম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।
তারপর বলেন,
— “ভবিষ্যতে এসব আর যেন না হয়।”

বাঁচল রুদ্র। কিন্তু তার চেয়ে বড় ব্যাপার, মেহরিন আজ তার হয়ে কথা বলল।

পরীক্ষা শেষে রুদ্র মেহরিনের  কানে কানে বলল,

— “তোমাকে একটা উপহার দেব।”
— “উপহার?”
— “হ্যাঁ, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা…”

স্কুল ছুটির পরে রুদ্র তার ব্যাগ থেকে  একটা   ডায়েরি বের করলো।
তার ভেতরে ছোট ছোট কিছু লেখা, আঁকা কিছু ছবির মতো স্মৃতি।

এক পাতায় লেখা:

“তোমাকে দেখে আমার প্রথম ভালো লাগা শুরু হয়েছিল, যখন তুমি আমাদের স্কুলের ভর্তি হওয়ার জন্য এসেছিলে । আমি অপলক দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।অদ্ভুত এক মায়াছিল তোমার সেই মুখে  আর সেই দিন থেকে আমার খামখেয়ালির শুরু। আজ তোমাকে দিলাম আমার খামখেয়ালি মনে রাখা ডায়েরিটা।”

মেহরিন একবার তাকাল রুদ্রের দিকে।

প্রথমবার সে কিছু বলল না। কিন্তু তার চোখে ছিল এমন এক চাহনি, যেটা শব্দে বোঝানো যায় না।

---

✦ চতুর্থ পর্ব: 

মেহরিন সেই রাতটা ঘুমাতে পারেনি।

রুদ্রের দেওয়া পুরনো ডায়েরিটা নিয়ে বসেছিল সে—নীলাভ কাভারে হাতের লেখা, কিছু জায়গায় জল পড়া দাগ, আর পাতায় পাতায় পাগলামির ছাপ। কিন্তু প্রতিটি পৃষ্ঠায় লুকিয়ে আছে এক গভীর ভালোবাসা, এক খামখেয়ালি হৃদয়ের আত্মপ্রকাশ।

প্রথম পাতায় লেখা—

“এই ডায়েরি তার জন্য, যে আমার পৃথিবীতে এসে সব এলোমেলো করে দিয়েছে।
আমি হয়তো কখনও সাহস করে বলব না,
কিন্তু লিখে যাব... যতদিন মনে থাকবে।
তার নাম—মেহরিন।”

মেহরিনের বুক কেঁপে উঠল। সে কখনও কল্পনাও করেনি যে রুদ্র তাকে এতদিন ধরে এত গভীরভাবে দেখছে, অনুভব করছে।
প্রতিটি পাতায় লেখা—

• কখন সে প্রথম চুল খুলে এসেছিল স্কুলে

• কোন দিনে সে কাঁদছিল করিডোরে দাঁড়িয়ে

• কোন রংয়ের ওড়না পরলে তাকে “একটু বেশিই সুন্দর” লাগে

• এবং একটা পাতায় লেখা ছিল—

“যদি কোনোদিন সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, আমি আমার সব খামখেয়ালিপনা ছেড়ে দেব।”

সেই রাতেই মেহরিন ডায়েরির শেষ পাতায় একটা নতুন লেখা যোগ করল, পেন্সিল দিয়ে—

“আজ প্রথমবার, আমি ওর চোখে সত্যি একজন আপন মানুষকে দেখেছি।
ওর ডায়েরিটা যেন আমার ‘নিজেকে ফিরে পাওয়ার আয়না’।
হয়তো, আমি এতদিন ওকে ভুল বুঝেছি।
হয়তো আমি ভালোবেসে ফেলেছি ওর খামখেয়ালিপনাকে।”

---

পরদিন স্কুলে আসতেই একটা গুঞ্জন—

“রুদ্র-মেহরিন প্রেম করছে!”
“ডায়েরি দিয়ে প্রেম প্রপোজাল!”
“মেহরিন নাকি এখন রুদ্রের সঙ্গে টিফিন করে!”

মেহরিন চুপচাপ সোজা চলে যায় ক্লাসে। কিন্তু সহ্য করতে পারে না যখন দু-তিন জন মেয়ে এসে বলে,
— “তুইও না! এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়লি?”
— “ও তো একটা উড়নচণ্ডী... তোর মতো মেয়ে ওর সঙ্গে যায়?”

রুদ্র জানে এইসব কথা কেমন কষ্ট দেয়। সে চুপচাপ এসে মেহরিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে—

— “তুই চাইলে আমি পুরো স্কুলকে বলব, আমরা শুধু বন্ধু।”
— “তুই চাইলে আমি স্কুলটাই ছেড়ে দেব।”
— “কিন্তু আমি চাই, তুই যা বলবি, সেটা মন থেকে বলিস। ভয় পেয়ে না।”

মেহরিন এবার প্রথমবার তার দিকে তাকিয়ে বলে—

— “আমি কিছুই লুকাব না।
আমার বন্ধুত্ব তোকে দিয়েছে হৃদয়ের স্পর্শ।
আর যদি কিছু শুরু হয়, সেটা সবাই দেখুক,
কারণ তুই আমার খামখেয়ালি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সত্যি।”

রুদ্র চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ,
তারপর বলল—
— “তোর কথায় মন ভালো হয়ে যায় রে, বোরিং মেয়ে।”
— “আমি বোরিং? তাহলে তুই তো পুরো নাটক।”
— “তুই আমার গল্পের প্রথম পাতায় লেখা নাম।”

✦ পঞ্চম পর্ব:

স্কুলে চলছে সাংস্কৃতিক সপ্তাহের প্রস্তুতি। নাটক, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য—সব মিলিয়ে যেন উৎসবের আমেজ। স্কুলের বড় ছেলেমেয়েরা মঞ্চের রিহার্সেলে ব্যস্ত, আর ক্লাস নাইনের ছেলেমেয়েদের মধ্যে তো উৎসাহ যেন বাঁধ মানছে না।

ম্যাডাম এসে বললেন,
— “এবার আমরা একটা ছোট নাটক করব—‘অচেনা অনুভব’।
রুদ্র, তুমি নায়ক হবে। মেহরিন, তুমি নায়িকা।”

সারাঘর হো হো করে উঠল—
— “রুদ্র-মেহরিন! ওফফ!”
— “ওদের তো আগে থেকেই রিহার্সেল শেষ!”
— “লাইভ লাভ স্টোরি তো!”

মেহরিন লজ্জায় মাটিতে গুঁড়ি মারে। রুদ্র হাঁসতে হাঁসতে বলে,
— “এই সুযোগে তুই আমাকে ‘ভালোবাসি’ বলেই ফেলবি।”
— “নাটকে বললে তো আর আসল না…”
— “তাহলে নাটককে আসল বানাব?” — রুদ্র চোখ টিপে।

---

রিহার্সেল শুরু হলো।

নাটকের গল্পটা এমন—
এক খামখেয়ালি ছেলে, যে ভালোবাসতে জানে না,
আর এক মেয়ে, যার প্রেম চাপা পড়ে যায় নিজের ভিতরেই।
শেষ দৃশ্যে, ছেলেটা মেয়েটির হাতে চিঠি দিয়ে মঞ্চ থেকে চলে যায়।

রুদ্র ও মেহরিনের মধ্যে সেই দৃশ্যের অভিনয় চলছিল।

রুদ্র সত্যি সত্যি একটা চিঠি দিল—নাটকের জন্য, সেটাই স্ক্রিপ্ট।
কিন্তু মেহরিন যখন হাতে চিঠিটা পেল, অবাক হয়ে দেখে চিঠির ওপরে ছোট করে লেখা—
"এইটা আর স্ক্রিপ্ট না। এটা সত্যি। পড়িস শেষে।”

তবু সে কিছু না বুঝে অভিনয় চালিয়ে যায়। নাটক শেষে স্কুলপ্রাঙ্গণে দর্শকদের করতালিতে ভরে যায় চারদিক।

---

সেই রাত।

মেহরিন চিঠিটা খুলল।

চিঠিতে লেখা:

**“তুই তো সব সময় বলিস, নাটকে যা হয়, তা অভিনয়।
কিন্তু আমি অভিনয় করিনি।
আমি তোর চোখে সত্যি প্রেম খুঁজেছি।
আমি চেয়েছি তোকে ছুঁয়ে দেখি সেইভাবে, যেমনটা গল্পে হয়।
তুই যদি বলিস—‘এইটা নাটক না’, আমি তোর খাতা, তোর ডায়েরি, তোর চোখের জল—সব হয়ে যেতে চাই।”

— রুদ্র”**

মেহরিন ডায়েরির এক কোণে লিখল—

“আজ প্রথম, রুদ্রকে দেখে অভিনয় মনে হলো না। মনে হলো, সে আমার জীবনের আসল চরিত্র।”

---

✦ ষষ্ঠ পর্ব: 

নাটকের সাফল্যের পর স্কুলজুড়ে মেহরিন আর রুদ্র যেন আলাদা আলোয় জ্বলছে।
ছাত্রছাত্রীদের ফিসফাস, টিচারদের চোখ টিপে হাসি—সব কিছুতে একটাই নাম ঘুরে ফিরে আসে,
"রুদ্র-মেহরিন"।

মেহরিন নিজের মতো থাকে ঠিকই, কিন্তু তার চোখে একটা অন্যরকম আলো, একটা নির্ভার প্রশান্তি।
অন্যদিকে রুদ্র, সে যেন একটু শান্ত হয়ে গেছে, এখন আর ক্লাসে অতটা দুষ্টুমি করে না,
কখনও কখনও চুপ করে বই নিয়ে বসে, আর মেহরিনের দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হেসে নেয়।

---

একদিনের ঘটনা:

টিফিনের সময় সবাই নিচে খেলছে। মেহরিন উপরে ক্লাসরুমে একা ছিল। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল,
তার ব্যাগটা খোলা! আর তার ডায়েরিটা টেবিলের ওপরে পড়ে আছে… খোলা অবস্থায়!

সে ছুটে গিয়ে দেখে—ডায়েরির সেই পাতাটি যেখানে সে রুদ্রের জন্য নিজের অনুভব লিখেছিল,
তা কেউ পড়ে ফেলেছে!

কয়েকজন মেয়ে হেসে বলল,
— “উফফ! এই যে ‘তোর চোখে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই’—এটা না  তোর লেখা?”
— “রুদ্র তোকে ‘খামখেয়ালি প্রেমিকা’ বলেছে?”
— “আহা! কি রোমান্টিক!”

মেহরিন ঘামতে থাকে। ওর মুখ শুকিয়ে যায়। এতটা অপমান, এতটা ভাঙনের মুহূর্ত সে কল্পনাও করেনি।

তার ঠিক কিছুক্ষণ পর ক্লাসে ঢুকলেন রুদ্র, আর তার সঙ্গে এক অভিভাবক—রুদ্রের মা।

ম্যাডাম বললেন,
— “আপনার ছেলে সম্পর্কে আমরা কিছু অভিযোগ পেয়েছি… সে মেয়েদের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করছে, চিঠি দিচ্ছে, নাটকের নামে প্রেম ছড়াচ্ছে!”

রুদ্র হতভম্ব। সে কিছু বলতে পারে না।

তার মা বললেন,
— “রুদ্র, এসব কী শুনছি আমি? তুমি পড়াশোনায় মন দাও, না এসব নাটকীয় প্রেমে?”

মেহরিন সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়ে। সবার সামনে, শিক্ষকদের সামনে, বলল—

— “স্যার, ওই নাটকের চিঠি আমি তাকে দিইনি।
তিনি আমাকে চিঠি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা কোনো বাড়াবাড়ি নয়।
আর যদি ভালো লাগাকে ‘অপরাধ’ বলা হয়, তাহলে আমরা স্কুলে শুধু বই না, অনুভবও শিখি না কি?”

ঘরটা স্তব্ধ হয়ে যায়।

রুদ্র তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে, যার ভিতরে এত সাহস লুকিয়ে আছে!

শিক্ষক একটু নরম হয়ে বলেন,
— “এই বয়সে আবেগ থাকেই। তবে তোমরা যেন একে সম্মান দিতে শেখো।”

রুদ্র মুচকি হেসে বলল,
— “স্যার, আমরা ভালোবাসি—অভিনয় না, দায়িত্ব নিয়ে।”

---

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় মেহরিন তার ডায়েরির একদম শেষে লিখল:

“আজ আমি লজ্জিত নই, আমি গর্বিত।
আমি তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, কারণ সে আমার জীবনজুড়ে লেখা একটা সাহসী নাম—
রুদ্র।”

✦ সপ্তম পর্ব: 

শীতের শুরু। সকালে হালকা কুয়াশা, পাখির ডাক, স্কুলে পিকনিকের প্রস্তুতি।

পুরো স্কুল মাতোয়ারা—ছেলেমেয়েরা তালিকা করছে, কে কোন গ্রুপে থাকবে, কে কোন বাসে যাবে, কে রান্না করবে, কে গিটার বাজাবে।

রুদ্র মাইকে গান গাইবে বলেছে, আর মেহরিন? সে ঠিক করেছে—এই সফরে রুদ্রকে চমকে দেবে, বলবে...
“আমি আর অভিনয় করতে পারছি না। তুই আমার সত্যি ভালো লাগা।”

---

পিকনিকের দিন।

সবাই ব্যস্ত, আনন্দে ভরপুর। বাসগুলো একে একে এসে স্কুল মাঠে দাঁড়াল। রুদ্র সাধারণত সবার আগে আসতো, চিৎকার করে বলতো;
— “চলো ভাই চলো! পিকনিক মানেই আজকের দিনে প্রেম শুরু হতেই হবে!”

কিন্তু আজ... রুদ্র নেই।

সময় গড়িয়ে যায়। এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা...
সবাই রওনা দিল, কিন্তু মেহরিনের চোখ শুধু স্কুল গেটের দিকে।
কোথায় রুদ্র?

---

পিকনিক স্পটে সবাই হুল্লোড় করছে—গান, হাসি, নাচ, খাবার।
কিন্তু মেহরিন চুপচাপ একটা গাছের নিচে বসে আছে।

হঠাৎ পেছন থেকে একজনে বলল,
— “তাকে খুঁজছো?”
— “হুম।”
— “সে আজ আসবে না। ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ও হঠাৎ করে ঢাকায় গেছে।”

মেহরিন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।

সে চোখ বন্ধ করল। ভেতরে কী এক শূন্যতা জমে উঠছে।
যেন চারপাশে এত আনন্দের ভিড়ে, সে একা দাঁড়িয়ে আছে।

রাতের দিকে সবাই যখন বাসে ফিরছে, মেহরিন মোবাইল খুলে দেখে,
রুদ্রের মেসেজ —

“তোর কাছে না এসে আজকের দিনটা কেমন ফাঁকা লাগছে, জানিস?
আমি তোকে না বলেই চলে এলাম... কারণ তোকে কাঁদাতে চাইনি।
কিন্তু তুই জানিস, তোর মুখ না দেখলে আমার খামখেয়ালি মনও আজ আর হাসে না।
আমি ফিরে আসব, তোর নীরব চোখের সামনে আবার দাঁড়াব।
তুই শুধু অপেক্ষা করিস।
— রুদ্র”

---

সেদিন রাতে মেহরিন প্রথমবার রুদ্রকে মিস করল—মন দিয়ে, চোখ দিয়ে, পুরোটা হৃদয় দিয়ে।

ডায়েরির পাতায় সে লিখল:

“যে চলে গেছে, সে আবার ফিরবে—এই আশাতেই বাঁচি।
কারণ ভালোবাসা কখনো হারায় না, শুধু অপেক্ষা শেখায়।”

---

★ অষ্টম পর্ব: 

পিকনিকের পরদিন স্কুলে আসার সময়টুকুই যেন মেহরিনের কাছে অন্যরকম হয়ে গেছে। প্রতিদিন যেখানে রুদ্র সকালে এসে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে বলত,
— “আজ আবার নতুন পাগলামি শুরু!”
সেই জায়গাটাই আজ শূন্য।

একদিন, দুইদিন, তিনদিন—রুদ্র নেই।

ক্লাসে রুদ্রের খালি চেয়ারটা যেন মেহরিনকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে—
“কেউ একজন নেই, কিন্তু তার ছায়াটা রয়েই গেছে।”

---

সপ্তাহখানেক পর।

স্কুলে গুঞ্জন—
“রুদ্র নাকি আর ফিরবে না।”
“ওর পরিবার নাকি ঢাকাতেই স্থায়ী হচ্ছে।”

মেহরিন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।

সে লাইব্রেরির কোণে বসে নিজের ডায়েরির পাতা উল্টে, সেই শেষ চিঠিটা বার  বার করে আবার পড়ে—

“...আমি ফিরে আসব, তোর নীরব চোখের সামনে আবার দাঁড়াব...”
তার চোখ ভিজে যায়।

---

একদিন দুপুরে।

মেহরিনের হাতে একটি খাম এসে পৌঁছায়। পোস্ট অফিস থেকে।
পরে জানা যায়—রুদ্র পাঠিয়েছে।

সে থরথর করে খামটা খুলে দেখে—
ভেতরে একটি চিঠি, আর একটি ছোট ছবি—তুলে রাখা সেই পিকনিকের দিনটার, যেখানে তারা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল।

চিঠিতে লেখা—

**“মেহরিন,
আমি জানি, কথা রেখেও রাখতে পারিনি।
মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আমরা ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে এসেছি।
স্কুল, বন্ধু, তুই—সব যেন হঠাৎ ফেলে রেখে এলাম।

কিন্তু তুই কি জানিস, প্রতিদিন তোর কথা মনে পড়ে?
আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখি, তুই ক্লাসে বসে আছিস, চুল ঠিক করছিস, ডায়েরিতে কি যেন লিখছিস।
আমি তোর সেই খামখেয়ালি প্রেমিক—যে আজও তোর একটা হাসির অপেক্ষায় আছে।

তুই যদি কখনও মন থেকে আমায় মনে করিস…
আমি ফিরব।
একদিন, ঠিক সেই বেঞ্চে, ঠিক সেই ডায়েরির পাতায় আবার আমায় লিখিস।

— রুদ্র”**

---

চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরে মেহরিন ফিসফিস করে বলল—
“তুই আমার গল্প থেকে হারিয়ে যেতে পারিস না, কারণ তুই তো আমার গল্পের শুরু।”

সেই রাতেই মেহরিন তার ডায়েরির একদম শেষ পাতায় লিখল—

“আজ আমি কাউকে বলিনি, কিন্তু রুদ্র... আমি তোর অপেক্ষায় আছি।
তুই ফিরবি—আমি জানি।
সেই খামখেয়ালির ভালোবাসা কি আর হারিয়ে যেতে পারে?”

---

---

✦ নবম পর্ব: 

এক বছর কেটে গেছে।
মেহরিন একদম বদলে গেছে—সে এখন ক্লাস টেনের শেষ বর্ষে।
প্রজেক্ট, পরীক্ষা, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে হাসি-আনন্দ, সবকিছুর মাঝেও তার মনে একটা শূন্যতা রয়ে গেছে—রুদ্রের জন্য।

দিনের শেষে সে এখনও এক কোণে বসে ডায়েরি খুলে তার লেখা পড়ে, স্মৃতির ঝুড়ি ঝাড়ে।

---

একদিন বিকেলে, স্কুলে নতুন ছাত্র ভর্তি হলো—কেউ তাকে দেখেই চিনলো না।
সে ছিল রুদ্র!

এক বছরে শারিরিক গঠনে অনেকটা  চেন্স এসেছে রুদ্রের শরীরে।

আর তাদের ক্লাসে যে চঞ্চল, উড়নচণ্ডী, ও দুষ্ট স্বভাবের একটা ছেলে ছিলো, সেটা তো সবাই ভুলতে বসেছে।

ওই দিন স্কুলে রুদ্র একা আসেনি, তার সাথে একটা মেয়ে এসেছে।

—হালকা গাঢ় চুল, সাদা স্কার্ফ, আর ভীতসন্ত্রস্ত চোখ।

রুদ্রকে দেখে মেহরিনের  হৃদয়টা দোলা দিল।

---

সবার কৌতূহল বাড়ল।
সে মেয়েটি কে?
কেন রুদ্র তাকে নিয়ে এসেছে?
এই ফেরতের সঙ্গে কি এক নতুন গল্প শুরু হচ্ছে?

স্কুলের সবাই যখন রুদ্রের সাথে থাকা মেয়েকে নিয়ে আলোচনা করছে, সে সব কিছুই মেহরিনের কানে আসছে। 

_কেউতো বলছে এটা রুদ্রের  কাজিন হতে পারে। 

_আবার কেউ বলছে রুদ্রের নতুন প্রেমিকা।

রুদ্র কে নিয়ে সবার এত মন্তব্য  মেহরিনকে দুর্বল করে দিচ্ছে। 

রুদ্র এসে চুপচাপ দাঁড়ালো মেহরিনের সামনে, একটু দ্বিধা নিয়ে বলল—
— “মেহরিন, আমি ফিরেছি... আর সঙ্গে আছে কেউ।”

---

✦ দশম পর্ব: 

স্কুলের চতুর্থ তলায় ক্লাস শেষে রুদ্র দাঁড়িয়ে ছিল মেহরিনের সামনে। পাশে তার হাত ধরেছিল এক মেয়ে—তার নাম ছিল রিয়া।
রিয়া  রুদ্রের আপন খালাতো   বোন, যাকে পরিবারের কারণেই মফস্বল থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

রুদ্রের মা যখন অসুস্থ ছিলো , তখন  রিয়াই তার মায়ের সেবা যত্ন করেছে।

পরিবারের মতেই বিয়ে করতে হয় রিয়াকে। 
অর্থাৎ রিয়া ছিল শুধু রুদ্রের সঙ্গিনী নয়, পরিবারের দায়িত্বের এক অংশ।

রুদ্ররা এখন গ্রামে ফিরে এসেছে, সেই স্কুলে আবার ভর্তি হয়েছে রুদ্র, সাথে রিয়া কেও ভর্তি করিয়ে দিল। রিয়ার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়। কিছুটা অভাব অনটনে  কেটেছে তাদের জীবন। যার জন্য রিয়া পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে নি।

তাই রুদ্র রিয়ার জীবনের দায়িত্বের পাশাপাশি পড়ালেখারও দায়িত্ব নিল। 

---

মেহরিন গাঢ় নিশ্বাস নিল। তার হৃদয় অচেনা ব্যথায় ভেঙে গেল,
কিন্তু সে মুচকি  হাসি দিয়ে বলল—
— “তুমি সুখে থাকো, রুদ্র।”

রুদ্র কিছুটা নিরুপায় হয়ে বললো-

—আমার ভুল বুঝনা মেহরিন;
মেহেরিন চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে রুদ্রকে বললো—হয়তো তুমি আমার ভাগ্যে ছিলে না। সবার ভাগ্যে তো সবকিছু জোটে না। 

রিয়া কিছু বলে না। সে শুধু চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।

---

সেদিন থেকে মেহরিন আর রুদ্রের সম্পর্ক খানিকটা দূরত্ব পেল। তারা ক্লাসমেট থাকলেও, মনের কথা বলতে পারতো না।
মেহরিন তার ডায়েরির পাতায় লেখে—

“তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা, কিন্তু হয়তো আমি তোমার শেষ না।
তবুও আমি চাই, তুমি সুখী হও।”

---

✦ একাদশ পর্ব: 

শেষ বর্ষের শুরু। বিকাশ বিদ্যাপীঠের ক্লাসরুমগুলোতে বাতাসে এক নতুন ধ্রুপদী আবেগ।
সবাই ভাবছে—আগামীটা কি হবে? নতুন স্বপ্ন? নতুন পথ?

---

মেহরিন আর রিয়া।
দু’জনের চোখে অদৃশ্য একটা দূরত্ব।
একটা কষ্টের সীমানা যা বলা হয় না, কিন্তু স্পষ্ট।
রিয়া জানে মেহরিনের জায়গা খালি নয়, আর মেহরিন জানে সে রুদ্রের পুরনো ভালোবাসার নাম।
কিন্তু কেউই মুখ খুলে কথা বলতে চায় না।

---

রুদ্রের মন—
সে চাপা কষ্টে ভরে আছে।  নিজের ভিতর দ্বন্দ্বে  জড়িয়ে যায় রুদ্র, 

—কাকে বেছে নিবে সে। 

""প্রথম ভালবাসা নাকি পরিবারের দায়িত্ব। 
দুই ভালোবাসার মাঝে বেঁচে থাকা কত কঠিন!
তার চোখে মেহরিন এখনও তার প্রথম ভালোবাসা, আর রিয়া তার বর্তমান দায়িত্ব।

---

একদিন, স্কুল ছুটির পরে, রুদ্র মেহরিনকে ডাকে লাইব্রেরির পেছনের বাগানে।

সে বলে,
— “তুই আমার জীবনের একটা বিশেষ মানুষ, আর আমি চাই তুই সুখে থাকিস।
আমি জানি, আমাদের মধ্যে অনেক কিছু বাকি আছে, কিন্তু এখন সেই সময়টা আর নেই।
আমরা সবাই বড় হচ্ছি, নতুন দায়িত্ব নিচ্ছি।
তুই যেন আমার কাছে রয়ে যাস, ভালোবাসার একটা স্পর্শ হয়ে।”

মেহরিন কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে,
— “তুই যতই দূরে থাকিস, তোর ভালোবাসার ছায়া আমার পাশে থাকবে।”

রুদ্র তখন মেহরিনের কাছে একটা আবদার করে। 

—মেহরিন আমি তোর কাছে একটা জিনিস চাই, তোকে যেদিন থেকে  ভালোবেসেছি, সেদিন থেকেই ইচ্ছেটা মনে পুষে রেখেছি। কিন্তু তোর কাছে জিনিসটা কখনো চাওয়া হয়নি, 

"কী সেটা, বল—

রুদ্র মেহরিনের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। 

কিছুটা লজ্জা পেয়ে মেহরিন,রুদ্রের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। 

মাথা নিছু করে বললো —"কী চাও বলো"

রুদ্র সব কিছু ভুলে গিয়ে মেহরিন কে বললো—"তোমার ওই ঠোঁট দুটো"

—যেদিন প্রথম ক্লাসের সামনে তোমার সাথে ধাঁক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছি,সেদিন থেকেই বলবো বলবো করে আর বলা হয় নি।নিয়তির কাছে আমরা হেরে গিয়েছি।আমাদের দুজনের পথ আজ দুদিকে। আমাদের আর কখনো মিল হবে নাকি জানিনা।তবে আজকে তোমার গোলাপের মতো ফুটে থাকা ওই ঠোঁটের স্পর্শ পেতে খুব  মন চাচ্ছে। 

—রুদ্রের কথা শুনে মেহরিন কাঁদতে শুরু করলো।

"রুদ্র তখন বলল" —তোমার মন না চাইলে  প্রয়োজন নেই আমি তোমাকে জোর করব না। প্লিজ তুমি কষ্ট পেয়ো না। তুমি কাঁদলে, আমারও ভীষণ কষ্ট হয়। 

"রুদ্র মেহেরিনের আরো সামনে আসলো,হাত দিয়ে মেহেরিনের মুখটা উপরে তুলল, মেহেরিনের দু'চোখ যেন দুটো নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে।না বলা, অনেক কথা অনেক স্বপ্ন লুকিয়ে আছে চোখের ভিতর। 

মেহেরিনের চোখ রুদ্রের চোখের দিকে পড়তে মেহেরিন লক্ষ্য করল রুদ্রের চোখেও জল। 

—মেহেরিন তখনই সবকিছু ভুলে গিয়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরল।চোখ বন্ধ করে ঠোঁট দুটো রুদ্রের ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেল। 

রুদ্র তখনই  মেহেরিনের ঠোঁটে আলতোভাবে কিস করল। মেহেরিনের ঠোঁটের স্পর্শে রুদ্র যেন পাগল হয়ে যাচ্ছিল। দুজন দুজনকে অনেকক্ষণ ধরে কিস করতে লাগলো। দুজনেই হারিয়ে গেল অন্য এক জগতে। 

তখনই রুদ্র মেহেরিন কে বলল "

—চলনা আমরা পালিয়ে যাই "

—তা আর হয় না রুদ্র,তুমি এখন অন্য একজনের দায়িত্ব নিয়েছো, তাকেও তো তুমি কষ্ট দিতে পারো না। সে কি দোষ করেছে বল। তার তো কোনো দোষ নেই।

✦ দ্বাদশ পর্ব:

 পরের দিন সবাই যথারীতি স্কুল এসে হাজির হলো। নতুন আরেকটি সকাল নতুন আরেকটি দিনের শুরু হল, কিন্তু রুদ্র মনে মনে মেহেরিন কে খুঁজছে। সে কোথাও মেহেরিনকে খুঁজে পাচ্ছে না।

— হঠাৎ স্কুলের বারান্দায় স্কুল ঘন্টায় ঠংঠং আওয়াজ হল। রুদ্র বুঝলো এখনই সবাইকে ক্লাসে ঢুকে যেতে হবে। কিন্তু ও কোথাও মেহরিনকে খুঁজে পাচ্ছে না।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রুদ্র ও ক্লাসে গিয়ে বসে পড়লো। 

—ক্লাসে স্যার ঢুকলো," ঠিক তারপরে মেহেরিন ক্লাসে এসে ঢুকলো। কিন্তু মেহেরিন একবারও রুদ্রের দিকে তাকালো না। 

মেহরিন বুঝে গেছে,  যত তাড়াতাড়ি রুদ্রকে ভুলে যাবে, ততোই তার ও রুদ্রের জন্য মঙ্গল।তাহলে দুজনই ভালো থাকবে।

—রুদ্র বার বার সুযোগ খুজছে মেহেরিনের সাথে কথা বলার জন্য।

মেহেরিন কোনো ভাবেই তাকে সুযোগ দিচ্ছে না।অনেকটা রুদ্রকে এড়িয়ে যাচ্ছে মেহরিন।

ঐদিন রুদ্রকে কিস করার পর, মেহরিন রুদ্রকে অনেক বেশি মিস করছিলো।

রুদ্রকে কাছে পেতে মন চাইছিল মেহরিনের।।কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না, রুদ্র এখন অন্য কারো হয়ে গেছে। আর সেজন্যই রুদ্রকে এড়িয়ে চলছে মেহেরিন। ওকে না দেখলে কষ্টটা হয়তোবা একটু কম হবে। 

শীতের হাওয়া বইছে স্কুল প্রাঙ্গণে।
মেহরিন আর রিয়া—দুজন দুজনেরই শত্রু। কিন্তু রিয়া মেহেরিনের কাছাকাছি আসতে চাইলো,রিয়া মেহেরিনকে বন্ধু হিসেবে পাশে পেতে চাইলো।

---

পরীক্ষার চাপ আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে বলতে, তারা খুঁজে পেল এক অদ্ভুত সমঝোতা—
নিজেদের জীবনে সুখ খুঁজে পাওয়া কঠিন হলেও, একে অপরের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব।

একদিন রিয়া মেহরিনকে বলল,
— “তুমি আমার জন্য নতুন পরিবার, নতুন সহানুভূতি।
আমরা সবাই তো কিছু না কিছু হারিয়েছি, 
তাই চল আগামীর স্বপ্ন গড়ি একসাথে।”

মেহরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে বলল,
— “আমাদের ভালোবাসার গল্প হয়তো আলাদা,
কিন্তু আমরা বন্ধুর মতো থাকতেই পারি।তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। 

---

আর রুদ্র?
সে দূর থেকে এই বন্ধুত্ব দেখে ভেতরে শান্তি খুঁজে পায়।
তার মনের ঝড় একটু শান্ত হয়ে আসে, সে বুঝতে পারে—সব ভালোবাসার গল্প একরকম হয় না,। 

কিন্তু সে মেহেরিন কে আজও ভালোবাসে । মেহরিন তার প্রথম ভালোলাগা ও প্রথম ভালোবাসা।যাকে সে কোন দিন ভুলতে পারবে না।

---

---

✦ ত্রয়োদশ পর্ব: 

ওদের শেষ বর্ষের বিদায় অনুষ্ঠান। 

স্কুল প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে ফুলে-ফুলে,
ছাত্র-ছাত্রীরা জমায়েত হয়েছে স্মৃতির শেষ পাতা আঁকতে।

---

মেহরিনের মনে এক মিশ্র অনুভূতি।
একদিকে ভালোলাগার স্মৃতি, অন্যদিকে বিচ্ছেদের বেদন।
সে খুঁজছে রুদ্রের চোখে সেই পলকের অপেক্ষা,
মেহরিন আজও রুদ্রকে ভালোবাসে।আজো সে নীরবে কাঁদে, তার প্রথম ভালোবাসা এভাবে হারিয়ে যাবে, সেটা কখনো কল্পনাও করে নি। 

---

স্কুলে বসেছিল ছোট একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
রিয়া মঞ্চে উঠলো, বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষে কিছু বক্তৃতা দিলো।

একে একে অনেকেই মঞ্চে উঠলো, যে যার মতো বক্তৃতা দিলো।

সবাই মেহরিনকে উঠতে বললো কিন্তুু মেহরিন মঞ্চে উঠতে চাইলো না।

অনেকটা দুরে, দাড়িয়ে ছিলো রুদ্র শিক্ষার্থীদের ভিড়ে তাকে প্রায় দেখাই যায় না।আর মেহরিন সামনে, ক্লাস টপারদের সাথে বসছে।  

ঐদিন মেহরিনকে একটু অন্যরকম লাগছিলো,,অনুষ্ঠান উপলক্ষে হালকা সেজে এসেছে সে।

নীল একটা জামা পড়েছে মেহরিন। চুলে এক পাশে সিথী করে খোপা করেছে। আর সেই খোপা জুড়ে সাদা ফুল। 

"যেনো এক সুভ্রতার প্রতীক।"

রুদ্র দূরে থেকে মেহরিনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে  তাকিয়ে রইলো।
মেহরিন সেটা বুঝতে পেরে অনেকটা অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়ে যায়।মেহরিন নিজেকে আড়াল করতে চায়, কিন্তু পারে না।

 আর এদিকে; রিয়া বক্তৃতা শেষে রুদ্রকে খুঁজে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর রিয়া দেখলো দূরে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। 

রুদ্রের কাছে যেতেই  রিয়া  লক্ষ্য করলো,,রুদ্র অপলক দৃষ্টিতে কি যেন দেখছে। 

সামনে এগিয়ে গেল রিয়া,রুদ্রের দিকে লক্ষ্য করেই সামনে তাকালো। 

রিয়া দেখলো রুদ্র অপলক দৃষ্টিতে মেহরিনকেই দেখছে।রিয়ার কিছুটা অভিমান হলো।কিছু না বলেই রিয়া ওখান থেকে চলে গেলো।

অনুষ্ঠান শেষে সবাই যে যার বাসায় চলে যাচ্ছে।

মেহরিন  স্কুলের গেট দিয়ে বেরোনোর আগে,রুদ্র এসে সামনে দাড়ালো।

রুদ্র মেহরিনকে বললো

— "দাঁড়া মেহরিন তোর সাথে আমার কথা আছে। 

কিন্তু মেহরিন তার সাথে কথা বলতে চায় না।

রুদ্র জোড় করে মেহরিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বাগানে। আর রিয়া সেটা আড়াল থেকে দেখতে পেলো।

রুদ্র মেহরিনকে বললো—

–তোর কি হয়েছে, মেহরিন।তুই আমাকে ইগনোর  করছিস কেনো?আমরাতো বন্ধু হিসেবে কথা বলতে পারি।

মেহরিন উত্তর দিল—

—দেখ রুদ্র তুই বিবাহিত। তোর বউ আছে, তুই আর আমার সাথে কথা বলতে আসবি না।ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেলে তারা আর কোনো মেয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড  হতে পারে না।রিয়া যেকোন সময় চলে আসবে, আর ও আমাদের এখানে দেখলে কষ্ট পাবে।তুই প্লিজ আমাকে আর ডিস্টাব করিস না।তুই রিয়াকে নিয়ে সুখে থাক।
— রিয়াকে আমি ভালোবাসি না,"চিৎকার করে বললো রুদ্র।
পরিবারের চাপেই রিয়াকে বিয়ে করেছি মাত্র। 

রুদ্র মাথা ঠান্ডা করে মেহরিন কে বললো;দেখ তুই যদি বলিস আমি রিয়াকে ডিভোর্স দিবো।তারপর তুই আর আমি একসাথে থাকবো, সুন্দর করে সংসার করবো।আমাদের স্বপ্ন গুলো পূরণ করবো। শুধু তুই আমার পাশে থাক। 

মেহরিন রুদ্রের কথায় কোনো সাপোর্ট করলো না।রুদ্রকে বললো;

—রুদ্র প্লিজ,, পাগলামো করিস না।তুই যা বলছিস তা আর সম্ভব না।সমাজ আমাদের মেনে নিবে না।আমাদের সবাই বাজে কথা বলবে।তার থেকে বড় কথা রিয়া তোকে ভালোবাসে, ও অনেক কষ্ট পাবে।

—তুই রিয়ার কথা চিন্তা করছিস, সমাজের কথা চিন্তা করছিস।কিন্তু একবারও তোর আর আমার কথা চিন্তা করছিস না।

রুদ্র ধিরে ধিরে মেহরিনের আরো সামনে এসে দাঁড়ালো। অনেকটা জোর করে মেহরিনের হাতের বাহু চেপে ধরলো।আর মুখটা মেহরিনের মুখের সামনে এনে বললো" 

"আমিযে তোকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।" সে দিন তোকে কিস করার পর তোকে আর ভুলতে পারছি না।বার বার তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তোর স্পর্শ, তোর ওই ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে ইচ্ছে করছে।

"এই কথা বলতে বলতে রুদ্র মেহরিনের আরো কাছে আসতে শুরু করলো"

মেহরিন ভয়ে পিছনে হাঁটতে লাগলো,

হঠাৎ মেহরিন দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো,ওর পিছনে দেয়াল আর সামনে রুদ্র। ও বুঝতে পারছে না ওর এখন  কি করা উচিত।

রুদ্র ওকে অনেক জরে ধরে রেখেছে।মেহরিন রুদ্রের হাত সরানোর অনেক চেষ্টা করলো। মেহরিন ব্যর্থ হলো।

রুদ্রের ঠোঁট মেহরিনের ঠোঁটের ঠিক সামনে, আর রুদ্রের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। 

রুদ্র মুখটা মেহরিনের কানের কাছে নিয়ে ফিস ফিস করে বলতে লাগলো;

—আজ তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। 

রুদ্রের ফিস ফিস আওয়াজ, মেহরিনকে কিছুটা উত্তেজিত করে তুললো।

রুদ্র মেহরিনের হাত দুটো চেড়ে দিলো, আর একটি হাত দিয়ে  মেহরিনের ঠোঁট দুটো স্পর্শ করতে লাগলো।

মেহরিন বুঝতে পারলো সেটা হচ্ছে সেটা ঠিক না,মেহরিন তখই রুদ্রকে ধাক্কা মারলো। আর রুদ্রকে বললো,সর রুদ্র,এগুলো তোর বউয়ের সাথে কর।আমার সাথে না। মেহরিনের ধাক্কায়  কিছুটা দুরে  সরে গেল রুদ্র।

আর সেই সুযোগে মেহরিন চলে যাচ্ছিলো।

রুদ্র পিছন থেকে মেহরিনকে চিৎকার করে বলতে লাগলো;

—মেহরিন 'আমি শুধু তোকেই ভালো বাসি। আর কাউকে না।আমাকে একা করে দিস না।আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না।বলে কাঁদতে লাগলো রুদ্র।

মেহরিনের কষ্ট হচ্ছিলো,কিন্তু তাও সে পিছোনে তাকালো না।বাসায় চলে আসলো সে।

বাসায় আসার পর,, মেহরিন অনেক বার রুদ্রকে ফোন করেছিল। কিন্তু তার ফোন বারবার বন্ধ পাচ্ছে। পরে মেহরিন রিয়াকে ফোন করলো,রিয়াও ফোন ধরলো না।খুব টেনশন হচ্ছে মেহরিনের। রুদ্রকি বাসায় গিয়েছে, নাকি এখনো বাগানে। মেহরিন আর কিছু ভাবতে পারছে না।খুব ভয় হচ্ছিলো তার। 

---

✦ চতুর্দশ পর্ব: 

তারপর কেটে গেলো কয়েক মাস।মেহরিনের রেজাল্ট অনেক ভালো হয়েছিলো।পরীক্ষা শেষে কলেজে ভর্তির দিন চলে এসেছে। মেহরিন গ্রাম ছেড়ে এবার শহরের কলেজে পড়ার জন্য চলে এসেছে।

হোস্টেলে থাকবে মেহেরিন। ঢাকায় তাদের তেমন কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। যার কারণে হোস্টেলে থেকেই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে মেহরিনকে।

কলেজ জীবনের প্রথম দিন।
মেহরিন নতুন ক্লাসরুমে প্রবেশ করল, চারপাশে নতুন মুখ, নতুন পরিবেশ।
তবে তার হৃদয়ে এক অজানা উচ্ছ্বাস আর ভিন্নরকম আশার ঝিলিক।

যেখানে রুদ্রের কোন ছায়া নেই। নতুন করে জীবন শুরু করার শপথ মেহরিনের জীবনে। পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করতে হবে তাকে। 

---

কলেজের পরিবেশে সে দ্রুত নতুন বন্ধু পেয়ে যায়।কিন্তু নতুন বন্ধুদের মাঝে সে যেন রুদ্রকে বার বার মিস করছে।
নতুন জীবন, নতুন স্বপ্নের মাঝেও, পুরনো ভালোবাসার ছায়া মুছে ফেলতে পারে না মেহরিন।

—কিন্তু রুদ্র এখন কোথায়? কি করছে সে। পরীক্ষার সময় দু একবার রুদ্রকে পরীক্ষা দিতে দেখেছিল। কিন্তু পরীক্ষার হল  আলাদা হওয়ার কারণে, কথা বলতে পারেনি রুদ্রের সাথে। রিয়ার সিটও পড়েছিল অন্য হলে। "বসে বসে ভাবছে মেহরিন। "

---

একদিন কলেজ ক্যাফেটেরিয়ায় মেহরিন তার বন্ধুদের সঙ্গে বসে গল্প করছিল,
সে হঠাৎ কলেজ গেট দিয়ে পরিচিত একজনকে ঢুকতে দেখল। 

কিছুটা লম্বা, ছোট ছোট চুল, আর দেখতে বেশ সুন্দর একটা ছেলে, অনেকটা রুদ্রের  মতো দেখতে। মেহেরিন এগিয়ে গেল। ছেলেটা ততক্ষণে কলেজের ভিতরে ঢুকে গেল। 

প্রায় ছয় তলা বিশিষ্ট একটা কলেজ, রুমও প্রায় অনেকগুলো। ছেলেটা কোন রুমে ঢুকেছে সেটা মেহেরিন ঠিক দেখেনি। আর সবগুলো রুমে গিয়ে খোঁজাও সম্ভব না।
মেহরিন হাল ছেড়ে দিল, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় আবার যুক্ত হলো। 
পরের দিন মেহরিন কিছু জিনিস কেনার জন্য মার্কেটে গেল। মেহেরিনের সঙ্গে তার কয়েকটা বান্ধবী ছিল। 

কেনাকাটা শেষে মেহরিন ও তার বান্ধবীরা একটা ক্যাফেতে ঢুকলো। সবাই কফি অর্ডার করলো। 

হঠাৎ মেহেরিনের চোখ পরলো,ক্যাফের শেষের দিকে একটা টেবিলে। 

একটা ছেলে আর মেয়ে গল্প করছে। ওদের টেবিলে অনেক নামিদামি খাবার দেওয়া হয়েছিল। বেশ বড়লোক মনে হচ্ছিলো।

কিন্তু মেয়েটিকে অনেক চেনা লাগছে মেহেরিন এর কাছে। "মেহরিন উঠে তাদের কাছাকাছি গেল। 

—"রিয়া, তুমি এখানে। কেমন আছো? 

টেবিলে বসা মেয়েটিকে বলল মেহেরিন।ওটা আসলে রিয়াই ছিল । রিয়াও মেহেরিন কে দেখে অবাক হয়ে গেল। 

বলল; মেহেরিন তুমি এখানে?

তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা হলো। রিয়ার সঙ্গে কথা বলে মেহেরিন বুঝতে পারল পাশের ছেলেটি রিয়ার হাজব্যান্ড। 

এক মাস আগেই তাদের বিয়ে হয়েছে। 

—রিয়া তোমার নাম্বারটা দিবে। তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।রিয়া মেহেরিন কে নাম্বারটা দিয়েদিলো।

বাহিরের কাজ শেষ করে হোস্টেলে ফিরে এলো মেহরিন। 

হোস্টেলে আসার পর থেকে কেমন যেন আনমনা হয় পড়েছে মেহেরিন। 

—রিয়া বিয়ে করেছে! কিন্তু রুদ্র কোথায়? ওদেরকি ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে । রুদ্র  কি এখনো আমাকে ভালোবাসে।নাকি অন্য কেউ এসেছে রুদ্রের  জীবনে?

বারবার প্রশ্নগুলোই মেহরিনের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। 

রাতে মেহরিন রিয়াকে ফোন করলো;

তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলো।

রিয়া তাকে সব খুলে বলল। 

—স্কুলের বিদায়ের দিন তোমার সঙ্গে কথা বলার পরে রুদ্র অনেক রাতে বাসায় ফিরে। অনেকটা মাতাল হয়ে। আমি ওর কাছে যেতেই, ও আমাকে দূরে ঠেলে দিল। আমি ওকে অনেক বোঝালাম, মেহেরিন এখন তোমার অতীত আমি বর্তমান। তুমি আমাকে মেনে নাও। ও বলল ;আমাকে কোনদিন ভালবাসতে পারবে না রুদ্র। ও নাকি শুধু তোমাকেই ভালবাসে।আমাদের মধ্যে অনেক ঝগড়া হলো। পরিবার আমাদের বিষয়টা জানলো। রুদ্রের ইচ্ছাতেই,, এসএসসি পরীক্ষার পরে আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। "রিয়া সব কিছু খুলে বলল মেহেরিনকে।

পরের দিন যথারীতি কলেজে উপস্থিত হলো মেহরিন।ক্লাসে বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলছে সে। মেহেরিন বসেছিল জানালার পাশে। হঠাৎ তার চোখ পরল বিপরীত পাশের একটা বারান্দায়। 

অনেকগুলো ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। হাসি ঠাট্টা আর মজা করছিল। মেহেরিন ক্লাস থেকে বের হয়ে, ওদের দিকে যেতে লাগলো। যতই সামনে এগোচ্ছে, একটা মুখ স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে। 

মেহেরিন অবাক হয়ে গেল, সে আর  কেউ নয় তার প্রথম ভালবাসা রুদ্র। 

মেহেরিন আর সামনে যেতে পারলো না, ফিরে এলো ক্লাসে।

✦ ১৫ তম পর্ব:

 নতুন আরেকটা দিন,

কলেজে আসার সময় আজকে মেহেরিন একটু সেজেগুজে এসেছিলো।সে মনে মনে ভাবছে ;রুদ্র আবার তার জীবনে ফিরে এসেছে। 
পুরনো স্মৃতি আর নতুন আশা নিয়ে সে  রুদ্রের জীবনে  পা রাখবে। এবার আর সে রুদ্রকে ফিরিয়ে দিবে না। 

অতীতের খামখেয়ালি ভালোবাসা আজ আবার পূর্ণতা পাবে। 

মেহেরিন কলেজের গেট দিয়ে ঢুকছে, হঠাৎ একটা ছেলের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগলো। ছেলেটি মেহেরিনের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল।

মেহেরিন বিরক্ত বোধ করে ওখান থেকে চলে গেল ক্লাসে। ওর দিনটাই যেন মাটি করে দিল ছেলেটি। 

কলেজে ক্লাস শুরু হল, স্যার ক্লাসে ঢুকতেই একটা এনাউন্সমেন্ট দিলেন।

রুম চেঞ্জ করা হবে, কমার্সের স্টুডেন্টরা এই ক্লাসে আসবে, আর এই ক্লাসের স্টুডেন্টরা কমার্সের ক্লাসে যাবে। 

রুদ্রের এসএসসিতে রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় সাইন্স নিয়ে পড়তে পারেনি।তাই কমার্সে ভর্তি হয়েছে সে। 

মেহেরিন জানতো রুদ্র কমার্সের স্টুডেন্ট।মেহরিন হাসিমুখ নিয়ে ক্লাস থেকে বের হলো, রুদ্রের  সঙ্গে আজ তার মুখোমুখি দেখা হবে। 

সবাই লাইন ধরে যে যার কাছে যাচ্ছে। মেহরিন অপেক্ষায় আছে কখন তার রুদ্রের সাথে দেখা হবে। 

মেহেরিন যত সামনে এগোচ্ছে, ততই তার বুক ধুকধুক করছে। 

মেহেরিন কিছুক্ষণের জন্য তার চোখ বন্ধ করব,, তারপর চোখ খুলেই সামনে তাকাতেই সে রুদ্রকে দেখতে পেলো।

রুদ্র ও তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র অবাক হয়ে মেহরিন কে দেখছে। 

—এতদিন পর এ আমি কাকে দেখলাম।সে তো আমার প্রথম ভালবাসা। যাকে আমি কয়েক মাস আগে হারিয়ে ফেলেছি। রুদ্র  অনেকটা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরেও , পিছনে  তাকিয়ে মেহেরিনকে দেখছে। 

—এই ব্যাটা সামনে তাকা,পড়বি তো। কাকে দেখছিস এমন করে। কেউ একজন বললো রুদ্রকে। 

মেহেরিন মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়ল। 

রুদ্র আজ আবার তার ভালোবাসাকে ফিরে পেলো।রুদ্রের মন অস্থির হয়ে আছে কখন সে মেহরিনের সাথে দেখা করবে, তার সাথে কথা বলবে।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর ঘন্টা বাজলো, স্যার ক্লাস থেকে যাওয়ার আগে রুদ্র বেরিয়ে পড়ল।স্যার বলল ;

—এই ছেলে তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমি এখনো ক্লাস থেকে বের হই নাই, তুমি কিনা আমার আগেই চলে যাচ্ছো।

রুদ্র স্যার কে বলল ;—

স্যার প্লিজ একটু তাড়া আছে। আমাকে আটকাবেন না আজকে। স্যার আর ওকে কিছু বললো না।

রুদ্র দৌড়ে  মেহেরিনের ক্লাসের সামনে চলে গেল, স্যার বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে রুদ্র। 

স্যার বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র ক্লাসে ঢুকে পড়লো। 

মাঝের শারিতে বসেছিল মেহেরিন, হঠাৎ তার চোখ পড়লো  রুদ্রের দিকে।

রুদ্র দৌড়ে এসে মেহেরিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ক্লাসের বাইরে। 

ক্লাসের সবাই হা করে তাকিয়ে রইল। কি হচ্ছে এগুলো। এরা কি চিনে একজন আরেকজনকে । সবার মনে একই প্রশ্ন? 

কলেজের একটু পাশে নিরিবিলি একটা জায়গা ছিল, সেখানে তেমন কোন স্টুডেন্ট আসে না। রুদ্র সেখানে নিয়ে গেল মেহরিনকে। 

রুদ্র মেহেরিনের হাত ছেড়ে দিল, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কেউ যেন কথা বলতে পারছে না, এতদিন পর আবার দেখা হলো দুজনের, কি বলবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না কেউ।দুজন দুজনকে শুধু দেখছে। 

—কেমন আছো তুমি মেহেরিন? হঠাৎ রুদ্র প্রশ্ন করলো মেহরিনকে।

—আমি তোমাকে ছাড়া ভালো ছিলাম না রুদ্র। মেহেরিন উত্তর দিল। 

—রুদ্র বলল, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? 

—হ্যাঁ,অনেক ভালোবাসি। 

—তাহলে ওই দিন আমাকে একা রেখে চলে গেলে কেন? 

—ঐদিন আমি অসহায় ছিলাম রুদ্র, আমার কিছু করার ছিল না। রিয়া তোমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তখন। আমি রিয়ার সংসার ভাঙতে চাইনি। 

রুদ্র বলল—
— “তুই আমার প্রথম ভালোবাসা, তুই আমার শেষ ভালোবাসাও।
আজ থেকে আমাদের নতুন শুরু, জীবনের প্রতিটি দিন একসাথে।”

মেহরিন চোখে জল নিয়ে হাসল—
— “আমি অপেক্ষা করেছিলাম এই দিনের জন্য,
সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা আজ পূর্ণতা পেল।”

সেই খামখেয়ালী ভালোবাসা 💙

★১৬ তম পর্ব :আজকের দিন টা একটু অন্যরকম সুন্দর ছিল। রুদ্র আর মেহরিনের কাছে । তারা পুরনো ভালোবাসাকে নতুন করে ফিরে পেলো।

 রুদ্রের  একটা বন্ধুর জন্মদিন ছিল, রুদ্র সেখানে যাবে।রুদ্র মেহেরিন কেও ফোন করে যেতে বলল জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। 

মেহরিন প্রথমে রাজি হয়নি,, রুদ্র জোর করাতে পরে রাজি হলো।

অনুষ্ঠানটা রাত আটটার পরে, সবাই এসে উপস্থিত।কিন্তু মেহেরিন এখনো এলোনা। রুদ্র অপেক্ষা করছে তার জন্য।সবাই রুদ্রকে বলল ;

—কিরে আয় তাড়াতাড়ি। কার জন্য অপেক্ষা করছিস তুই। তোর কি কোন গেস্ট আসবে। 

—হু,আসবে। তোদের জন্য সারপ্রাইজ আছে। 

আয়োজনটা একটা ক্যাফে রুম ভাড়া করে করা হয়েছিল। অনেকেরই গার্লফ্রেন্ড উপস্থিত ছিল সেখানে। 

সবার চোখ তখন দরজার দিকে, কে আসবে, এই কৌতুহল সবার মনে। 

দরজা দিয়ে ঢুকলো একটা মেয়ে, নীল শাড়ি পরা,  খোলা চুল,  কানের  পাশেই একটা গোলাপ ফুল লাগানো। ঠোটে হালকা লিপিস্টিক,চোখে কাজল, কপালে টিপ।

যেন আকাশ থেকে একটা পরী নেমে এসেছে, সবাই হা করে রইলো মেহেরিনের দিকে। রুদ্র কে  জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটা কে? 

—রুদ্র  মেহেরিন এর দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা💙

মেহেরিন কিছুটা লজ্জা পেল, কিন্তু উপস্থিত সবাই তাকে সাদরে গ্রহণ করল। মেহেরিন এসে রুদ্রের  পাশে দাঁড়ালো। দুজনকে বেশ মানিয়ে ছিল। 

উপস্থিত সবাই বলাবলি করছিলো।কথাগুলোর রুদ্র আর মেহরিনের কানে আশাতে লজ্জা পেলো দুজনেই।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পথে, রাত প্রায় বারোটা বাজে।এত রাতে হোস্টেলে গেলে,সবাই বাজে মন্তব্য  করবে। কি করবে মেহেরিন বুঝতে পারছে না। 

হঠাৎ রুদ্র মেহেরিন কে চিন্তা করতে দেখে তার কাছে এসে বলল ;

—কি হয়েছে! কি নিয়ে চিন্তা করছো তুমি। মেহেরিন কোন দ্বিধা না রেখে, কথাটা রুদ্রকে বলল। 

রুদ্র তখনই বলে উঠলো ;

—সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তুমি আজকে রাত্রে আমার বাসায় থাকবে। 

কালকে যখন হোস্টেলে সবাই তোমাকে জিজ্ঞেস করবে,রাতে কোথায় ছিলে? 

তখন তুমি বলে দিও যে আমার একটা বান্ধবীর বাসায় ছিলাম।

মেহরিন অবাক হয়ে বলল ;—আরে না, তোমার বাসায় যাব মানে! আমি তোমার বাসায় যেতে পারবো না। সবাই বাজে কথা বলবে।

রুদ্র  মেহেরিন এর কাছে এসে বলল ;

—অন্যকে নিয়ে চিন্তা করা অনেক হয়েছে, এবার শুধু আমাদের নিয়ে চিন্তা করবে। আমি তোমাকে কথা দিতে পারি, আমার বাসায় তোমার কোন সমস্যা হবে না। মেহেরিন রাজি হলো। 

—ওর বাসায় তো আন্টি আঙ্কেল আছে আশা করি কোন সমস্যা হবে না।"মেহরিন মনে মনে ভাবলো "।কিন্তু, রুদ্রের সংসার ভাঙ্গার জন্য আমি তো দায়ী। আমার জন্যই তো রুদ্র রিয়াকে নিয়ে সংসার করতে পারেনি। আঙ্কেল আন্টি যদি আমাকে বকা দেয়। মন খারাপ হয়ে গেল মেহেরিনের। 

রুদ্র এসে বলল —কিরে আবার কি হয়েছে তোর। এবার তো চল, অনেক রাত হয়ে গেল যে। 

বাসার সামনে এসে পৌঁছল দুজন। মেহেরিন খুব ভয় পাচ্ছে, বাসার ভিতরে যেতে চাচ্ছে না। রুদ্র ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। মেহরিন অবাক হল ;যখন দেখলো রুদ্র নিজেই চাবি দিয়ে দরজা খুলল। মেহরিন ভয়ে ভয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করল।

অনেকটা কৌতুহল নিয়ে রুদ্রকে প্রশ্ন করল মেহরিন —

—কিরে রুদ্র আঙ্কেল আন্টি কোথায়? 

—তুই আগে বস বলছি আমি। বলে রুদ্র ভিতরের রুমে গেল। 

রুদ্র তার গায়ে থেকে ব্লেজার খুলে বের হয়ে এলো। এসে মেহরিনকে  বলল _

—বাবা বিদেশে, পাঁচ বছর পর পর এসে আমার সাথে দেখা করে যায়।  "রুদ্র থেমে গেল।"

মেহরিনের প্রশ্ন, আর আন্টি?

—মা দু মাস আগে মারা গিয়েছিল; "কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো রুদ্র"

মেহেরির নিজেকে অপরাধী মনে করছিল। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। রুদ্রের কাছে গিয়ে মেহেরিন বলল ;আমি দুঃখিত রে আমি জানতাম না  বিষয়টা। রুদ্র মেহেরিনের  হাত দুটো জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। আর রুদ্র বলতে লাগলো ;

—তুই আমাকে কখনো ছেড়ে যাস না মেহরিন।আমি যে তোকে অনেক বেশি ভালোবাসি। এই পৃথিবীতে আমি যে বড় একা। আমায় সঙ্গ দিবি তুই? 

—আমি তোকে কথা দিলাম, তোকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না। আমিও তো তোকে ভালোবাসি💙

তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল। বেশ ভালই লাগছিল রুদ্রের। "এবার ছাড় রুদ্র " বলে উঠলো মেহেরিন। 

তারপর রুদ্র মেহরিন কে তার রুম  দেখিয়ে দিল 

—তুই এই রুমে থাক মেহরিন।

মেহরিন  রুমের ভিতরে ঢুকলো।রুমের চারপাশটা ঘুরে দেখছিলো।বিছানার উপরে এসে বসলো মেহরিন।মেহেরিনের শাড়িটা পড়ে শুতে অসুবিধা হচ্ছিলো।

রুদ্র কফি হাতে মেহেরিনের রুমে ঢুকলো। রুদ্র বুঝতে পেরেছে শাড়িটা মেহেরিনকে অনেক বিরক্ত করছে। কফিটা মেহরিনের হাতে দিয়ে রুদ্র রুম থেকে বের হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর রুদ্র একটা শাড়ি নিয়ে রুমে ঠুকলো।

—এই নে এই কাপড়টা পড়।আমার মায়ের সুতির কাপড়। তোর আরাম লাগবে।

মেহরিন শাড়িটা হাতে নিলো।

রুদ্র বেরিয়ে যেতেই, শাড়িটা চেঞ্জ করে নিলো মেহরিন।আয়নার দিকে তাকিয়ে কুচি ঠিক করছিলো মেহরিন।আচলটা নিচে পড়ে ছিলো।

রুদ্র একটা কথা বলতে এসেছিলো মেহরিনকে।মেহরিন আয়নার দিকে তাকানো,রুদ্র ঠিক তার পিছে। দরজায় হঠাৎ আওয়াজ হতেই, মেহরিন পিছনে ফিরে তাকালো।মেহরিনের আঁচলটা নিচে পড়ে আছে।রুদ্র ধীরে ধীরে  মেহরিনের সামনে আসতে লাগলো।

আঁচলটা হাত দিয়ে তুলে দিতেই, মেহরিন রুদ্রের সামনে থেকে সরে গেলো।রুদ্র আবার তার কাছে গিয়ে আঁচলটা তুলে দিলো,তারপর মেহরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বললো—

—তোকে অনেক সুন্দর লাগছে।💙রুদ্রের কথা আর নিঃশ্বাসের শব্দ  মেহরিনকে যেন পাগল করে তুললো।

রুদ্র আর মেহরিন একে অন্যের আরো কাছে আসতে লাগলো। রুদ্র  মেহেরিনকে কোলে তুলে খাটের উপর নিয়ে গেল। দুজনে দুজনকে ভালোবেসে অন্য এক জগতে হারিয়ে গেল। পিছনের সব কিছু ভুলে ওরা এগিয়ে গেল নতুন ভবিষ্যতের দিকে। 

ওরা ভুলেই গেল, ওদের এই ভালোবাসা সমাজ বা পরিবার কিভাবে মেনে নেবে।

ওরা আজ সমাজ বা পরিবারের কথা চিন্তা করলো না।শুধু নিজেদের কথা চিন্তা করলো।নিজেদের ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিলো।

---

ভালোবাসার পূর্ণতা :💙

মেহরিনের ঘুম ভাঙ্গার আগেই রুদ্র  ঘুম থেকে উঠে কোথাও একটা গেলো।

রুদ্র চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে মেহরিন ঘুম থেকে উঠলো। ঘুম থেকে উঠেই রুদ্রকে  খুঁজতে লাগলো মেহরিন। 

রুদ্রকে কোথাও না পেয়ে মেহেরিন তার রুমে এসে শুয়ে পড়লো। আর শুয়ে শুয়ে কালকে রাত্রের কথা চিন্তা করতে লাগলো। 

—তাদের দুজনের এক হওয়া, ভালোবাসার পূর্ণতা পাওয়া, সব যেন ঠিক কল্পনার মতই লাগছিল। রুদ্র তার এত কাছে আসবে, তাকে এত ভালবাসবে সেটা কখনো চিন্তাও করেনি মেহেরিন। 

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ। মেহেরিন সামনে এগিয়ে গেল। 

রুদ্র ঘরে ঢুকলো, 

ঘরে এসেই রুদ্র মেহেরিনের রুমে চলে গেল, মেহেরিনকে কাছে টেনে নিয়ে গুড মর্নিং বলে একটা কিস করলো।

—সকাল সকাল কোথায় গেলি তুই। মেহেরিন প্রশ্ন করলো রুদ্রকে। 

রুদ্র বলল পরে বলবো তোকে। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। মেহেরিন ঠিক বুঝে উঠল না কি  সারপ্রাইজ। 

মেহেরিন বলল, আমাকে এবার হোস্টেলে যেতে হবে, ওখান থেকে রেডি হয়ে কলেজে  যেতে হবে। 

রুদ্র বলল তোর আজ কোথাও যাওয়া হবে না। তুই এখন থেকে আমার সাথে আমার বাসায় থাকবি।

মেহেরুন কিছুটা আশ্চর্য হল, 

—কি বলছিস তুই, মানুষ দেখলে কি বলবে। বিয়ে ছাড়াই আমরা একসাথে থাকব। 

—এটা নিয়ে তুই কোন চিন্তাই করিস না। আমি সব কিছু ব্যবস্থা করছি।তুই শুধু আমার পাশে থাক। 

মেহেরিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই, রুদ্র একটা কাপড় দিয়ে মেহেরিনের চোখ বেঁধে দিল। তারপর মেহেরিনকে নিয়ে খাটের উপর বসালো।

রুদ্র তার পকেট থেকে কি যেন একটা বের করল। হাঁটু গেড়ে মেহেরিনের সামনে বসলো। 

—এবার চোখ খোল তুই, 

মেহেরিন চোখ খুলতেই রুদ্রকে বসে থাকতে দেখল আর রুদ্রের হাতে একটা ডায়মন্ডের আংটি দেখতে পেল। রুদ্র বলে উঠলো 

—will you marry me 💙

মেহেরিন রুদ্রের  সামনে বসে,  কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল "yes" 

রুদ্র মেহেরিন কে আংটি পরিয়ে দিল । 

দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কিস করলো।

দুজনেই তাদের বিষয়টি পরিবারকে জানিয়ে দিল। 

পরিবারের হাতে তখন কিছুই ছিল না। তাই তারা ওদের বিষয়টি মেনে নিল। 

দুজনেই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নিল। 

আর এভাবেই তাদের খামখেয়ালি ভালোবাসা পূর্ণতা পেল। তারা সুখে সংসার করতে লাগলো । আর তাদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে থাকলো। 

গল্পটি কেমন হয়েছে প্লিজ সবাই কমেন্টে জানাবেন। আপনাদের এই কমেন্ট আপনাকে আরো ভালো ভালো গল্প লিখতে সাহায্য করবে। ধন্যবাদ সবাইকে। 💙💙

💙