Sunday, June 15, 2025

নীলপরী নীলাঞ্জনা

গল্পের ভান্ডার ;





             নীলপরী নীলাঞ্জনা




নীলপরী নীলাঞ্জনা 💙

সুনীল পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটি গ্রাম – শান্তিপুর। সবুজ বন, ঝিরিঝিরি পাহাড়ি ঝরনা, আর দূরের নীলাকাশ যেন এখানে এসে থেমে গেছে। এখানে সময় চলে ধীরে ধীরে। গ্রীষ্মের বিকেলগুলো হয় একদম স্বপ্নের মতো — বাতাসে লেবুগাছের গন্ধ, দূরে বাঁশবাগানের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কাঠের পুরনো বাড়ি।

এই গ্রামের পাশেই এক অদ্ভুত নিরিবিলি জায়গা, নাম নীলপরীর গুহা। গ্রামের লোকেরা বলে, সেখানে কখনো কখনো এক মেয়েকে দেখা যায় — মাথাভরা চুল, নীল শাড়ি, আর চোখে গভীর নদীর মতো দৃষ্টি। কেউ বলে সে মানুষ নয়, পরী। কেউ বলে, সে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়।

নাম তার নীলাঞ্জনা
বয়স বেশি না — একুশ কি বাইশ হবে।
নাম শুনলেই কেমন একটা নীল ছায়া এসে ঘিরে ধরে হৃদয়কে।



অভি, ঢাকা শহরের এক তরুণ চিত্রশিল্পী, জীবনের কোলাহলে হাঁপিয়ে গিয়ে একদিন চলে আসে এই গ্রামে — ছবি আঁকার জন্য, নিজের ভেতরটা খুঁজে পাওয়ার আশায়।

একদিন বিকেলে সে চলে যায় পাহাড়ের পাশে, এক নিঃসঙ্গ গাছের নিচে বসে ছবি আঁকছিল। হঠাৎই ঝরনার নিচে একটা ছায়া দেখতে পেল — নীল শাড়ি পরা এক মেয়ে, এক হাতে জলে ছুঁয়ে কিছু অনুভব করছে।

অভির চোখ আটকে যায়।
তার মনে হয়, এই মেয়েকে সে আগে কোথাও দেখেছে — হয়তো কোনো স্বপ্নে, হয়তো কোনো পুরনো ক্যানভাসে।

সে হঠাৎ করে বলে ওঠে,
— "তুমি কি... মানুষ? নাকি পরী?"

মেয়েটি ঘুরে তাকায়, চোখে হালকা হাসি —
— "তুমি মানুষ বলেই প্রশ্ন করলে, নইলে বুঝে নিতে পারতে।"

তারপর মেয়ে হেঁটে চলে যায়... আর অভি বসে থাকে, একরাশ বিস্ময়ে।



পরদিন অভি গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে মেয়েটির কথা।
সবাই বলে,
— "ওহে বাবু, তুমি নিশ্চয়ই নীলপরী নীলাঞ্জনাকে দেখেছো। ওর কথা কেউ বলে না, শুনলে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়।"

কিন্তু কেন? কী এমন আছে মেয়েটির গল্পে?

কেউ জবাব দেয় না।

অভি ঠিক করে, সে খুঁজে বের করবে নীলাঞ্জনার সব রহস্য।
কে এই মেয়ে? কেন তার চোখে অতটা বিষাদ?
এবং কেনই বা সে মনে হয়, যেন তাকে অভি চেনে বহুদিন ধরে?




সন্ধ্যার রোদ পড়ে এসেছে। পাহাড়ে হালকা কুয়াশা নেমে এসেছে, আর গ্রামের বাতি একে একে জ্বলে উঠছে। অভি বসে আছে নিজের লজের বারান্দায়, হাতে স্কেচবুক — কিন্তু আজ তার তুলির কোনো আঁচড় নেই।

তার চোখের সামনে শুধু সেই মেয়েটি — নীল শাড়ির মতো স্নিগ্ধ, আর চোখে গভীর কিছু হারানোর হাহাকার।

তার নাম কি সত্যিই নীলাঞ্জনা?
না কি সে শুধু গ্রামের গল্প হয়ে বেঁচে থাকা এক নিঃসঙ্গ আত্মা?



পরদিন সকালে অভি গ্রামের পুরনো লাইব্রেরির দিকে হাঁটছিল। হঠাৎ দেখলো একজন বুড়ো লোক, মাটির পিঁড়িতে বসে চা খাচ্ছে। গায়ের চাদর, হাতে বাঁশের লাঠি — চোখে অদ্ভুত এক বোধি-শান্তি।

অভি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “চাচা, আপনি কি নীলপরী নীলাঞ্জনাকে চেনেন?”

বুড়ো লোকটি হাসলো হালকা করে।
— “তুই কি ওকে দেখছিস?”
— “হ্যাঁ… ঝরনার পাশে। কথা বলেছি… হয়তো স্বপ্নে?”

বুড়ো লোকটি গভীর শ্বাস নিলো।
— “নীলাঞ্জনা... ও ছিল সবার স্বপ্নের মেয়ে। শহর থেকে এখানে এসেছিল বছর পাঁচেক আগে। চুল ছেঁড়া বাতাসে উড়তো, আর গলায় ছিল গজলের মত সুর। সবাই বলতো, মেয়েটার চোখে নদীর মত বিষাদ আছে।”

— “তারপর?” অভির গলা শুকিয়ে আসে।

— “তারপর একদিন, ও হারিয়ে গেলো। কেউ বললো আত্মহত্যা করেছে, কেউ বললো ও পাহাড় ডেকে নিয়েছে। কেউ আবার বললো— ও পরী হয়ে গেছে... কারণ এখনো ঝরনার ধারে দেখা যায়, এক নীল শাড়ি পরা মেয়েকে। তবে কেউ কাছে গেলে, সে মিলিয়ে যায়।”

অভির শরীরের রোম কাঁপতে লাগল।

সে তো সেই মেয়েকেই দেখেছে! তবে কি সে... মৃত?



রাতে ঘুম আসছিল না অভির। জানালার বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ দেখতে পেল এক ছায়া —
একটা নীল শাড়ি, ধীরে ধীরে রাস্তা পার হচ্ছে... তার দিকেই তাকিয়ে।

অভি তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেল। কিন্তু বাইরে গিয়ে দেখল, কেউ নেই।
তবে বাতাসে ভেসে আসছে এক টুকরো গানের সুর —
একটা পুরনো রবীন্দ্রসংগীত...
"কে তুমি, নীলে ঢাকা..."

সে গলা সেই মেয়েটির!
সে জানে — সে সত্যিই ছিল, এখনো আছে।



পরদিন অভি স্কেচবুকে একটি ছবি আঁকে —
একটা ঝরনা, পাশে দাঁড়িয়ে এক নীল শাড়ি পরা মেয়ে, যার চোখে লুকিয়ে অসীম গভীরতা।

ছবির নিচে লেখে সে,
“আমি তোমায় খুঁজে পাবো, নীলাঞ্জনা। তুমি যদি স্বপ্ন হও, তাও তোমায় জাগরণে খুঁজবো।”




এক সপ্তাহ কেটে গেছে।
অভি এখন আর শুধু পাহাড়ের ছবি আঁকে না। প্রতিদিন সকালে সে বেরিয়ে পড়ে — ঝরনার ধারে, গুহার পথে, পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে। নীলাঞ্জনার দেখা সে আর পায় না, কিন্তু কোথাও একটা সে জানে — মেয়েটি তাকে দেখছে।



এক সকালে অভি পুরনো একটি বাঁশবনের পথ ধরে হাঁটছিল। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা কাঠের ভাঙা কুঁড়েঘর। কৌতূহলবশত সে ভেতরে ঢোকে। ধুলো জমা বই, ছেঁড়া কাগজ, ভাঙা আয়না — সব কিছুতেই জমে আছে ফেলে আসা কোনো এক জীবনের নিঃশব্দ চিহ্ন।

হঠাৎ একটা পুরনো খামে ভরা চিঠি পায় সে —
নীলচে রঙের পাতায় হস্তলিখিত কয়েকটি লাইন:

“আমার চোখের নীল দেখে অনেকে ভালোবেসেছে, কিন্তু কেউই আমার বিষণ্নতা বোঝেনি।
যার চোখে একদিন নিজেকে খুঁজেছিলাম, সে-ই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভুল বুঝেছিল।
আমি পালিয়ে যাচ্ছি, নিজেকে ফিরে পেতে। যদি কোনোদিন কারো ভালোবাসা সত্যি হয়ে আসে—
সে আমাকে খুঁজে নেবে এই পাহাড়েই।”

নীলাঞ্জনা

চিঠির লেখা দেখে অভির বুক কেঁপে উঠে।
সে বুঝে যায় — মেয়েটি পালিয়ে গিয়েছিল, মরেনি। আর তার অপেক্ষা এখনো শেষ হয়নি।



সন্ধ্যায়, যখন অভি কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে ফিরছিল, হঠাৎ ঝরঝরে বৃষ্টি নামে। এক পাহাড়ি মোড় ঘুরতেই একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
গাড়ি থেকে নামেন এক তরুণ — শার্ট-প্যান্ট পরা, চোখে সানগ্লাস। অভির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
— “আপনি কি এখানে নতুন এসেছেন?”

— “হ্যাঁ,” অভি উত্তর দিল।
— “আমি তাসিন। আগে এখানে থাকতাম... অনেক বছর পর ফিরলাম। একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছি। তার নাম ছিল নীলাঞ্জনা।”

অভি থমকে যায়।

এই নাম তার মুখে শুনে অভির বুক কেমন ধক করে ওঠে।
তাসিন বলল,
— “সে আমার বাগদত্তা ছিল… কিন্তু হঠাৎ করে হারিয়ে গেল। এখনো খুঁজে ফিরি ওকে।”

অভি কিছু বলতে পারল না।
নীলাঞ্জনা যদি তাসিনের হয়ে থাকে, তবে তার প্রতি অভির এই টান কী?

রাতে অভি বারান্দায় বসে, বৃষ্টির শব্দ শুনছিল।
সে ভাবছিল —

"তাসিন কি সত্যিই ভালোবাসে নীলাঞ্জনাকে?
তবে সে কেন তাকে ভুল বুঝেছিল?
আর কেন আজও মেয়েটি তার কাছে ফেরেনি?"

অভি জানে, তার হৃদয়ে আজ এক নীল নদী বয়ে চলছে।
এক মেয়েকে সে না জেনেও ভালোবেসে ফেলেছে।
আর সেই ভালোবাসা যেন প্রতি রাতে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
— “তুমি ওর খোঁজে এসেছো… এখন ও তোমার মধ্যেই খুঁজছে মুক্তি।”












রাত গভীর। অভির মন যেন অশান্ত এক সাগর। বারবার চোখ খুলে সে চেয়ে থাকে জানালার বাইরে, যেখানে রাতের নীরবতা মাঝে মাঝে নীল আলোয় ভেসে ওঠে।

সকাল বেলায় সে আবার পুরনো কুঁড়েঘরটিতে যায়। সেখানে সে পায় একটা ভাঙা ট্রাঙ্ক, আর ভেতর থেকে বের হয় এক পুরনো দিনলিপি। পাতা উল্টিয়ে পড়তে থাকে:

“২৫শে বৈশাখ: আজ তাসিন আমার গলায় বলেছে ভালোবাসে। আমি হাসি দিয়ে বলেছিলাম, ভালোবাসা শুধু কথা নয়, প্রমাণ চাই...
৩০শে জ্যৈষ্ঠ: ওর চোখ আজ অন্য কারো জন্য ছিল, আমি চুপ করে শুনলাম।
১২ই আষাঢ়: সিদ্ধান্ত নিয়েছি পালাবো, ভালোবাসা যদি বুঝতে না পারে, আমি আমার নীরবতাই বাঁচবো।”

অভির মন ভারাক্রান্ত হয়। বুঝতে পারে তাসিন ও নীলাঞ্জনার মধ্যে মধুর কিছু ছিল, কিন্তু বোঝাপড়া হয়নি।

বিকেলে ঝরনা ঘাটে ফিরে অভি দেখে নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে আছে, চোখে এক ধরনের বিষন্নতা। সে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কেন পালিয়ে গেছ?”
নীলাঞ্জনা চুপ করে থাকে, শেষে বলে,
“সবাই আমার রঙ ভালোবাসে, কিন্তু আমাকে নয়... তুমি পারবে আমাকে যেমন আমি, তেমন করে ভালোবাসতে?”
অভি বলে, “আমি তোমার চোখের ভিতরের নদী ভালোবাসি।”

নীলাঞ্জনার চোখ ভিজে ওঠে, কিন্তু সে কোনো উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ের দিকে হারিয়ে যায়।

সেই রাতে অভি ডায়েরিতে লিখে,
“ওর হৃদয়ের দরজা বন্ধ, তবুও আমি অপেক্ষা করব, কারণ আমি শুধু পরী নই, ওর মানুষটাকেই ভালোবেসেছি।”



অভির মনে তাসিনের কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। কি করে সে এসে নীলাঞ্জনার জীবনে এমন প্রভাব ফেলেছে?
তাসিন কি সত্যিই শুধু এক বাগদত্তা, নাকি এর পিছনে কিছু গোপন সত্য আছে?

এক বিকেলে, অভি ঠিক করে তাসিনের সাথে দেখা করবে।
ঝরনার ধারে দেখা হল দুই পুরুষের। এক জন ছিল অভি, আর অপরজন তাসিন।

তাসিন বলল,
“আমি নীলাঞ্জনাকে খুব ভালোবেসেছি, কিন্তু সে অন্য এক জগতের মেয়ে। সে শান্তিতে থাকতে চায়, আর আমি শহরের চাপে তাকে ধরে রাখতে পারিনি।”

অভি সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করল,
“তুমি কি কখনো ভেবেছো, ওর পিছু নেওয়া তোমার ভালোবাসা না ওর স্বাধীনতার মধ্যে বঞ্চনা?”

তাসিন খানিক থেমে বলল,
“হয়তো। আমি চাইনি সে হারিয়ে যাক, কিন্তু হয়তো আমি ওর পিছু ছাড়িনি।”

অভির হৃদয় নীরব, সে বুঝতে পারল ভালোবাসার সঙ্গে ক্ষমতাও যেন মিশে থাকে।
নীলাঞ্জনার জন্য একটা মুক্তির দরজা খোলার দায়িত্ব এখন তার।



অভি বাড়িতে ফিরে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল।
তাসিনের মুখোমুখি কথা তাকে এক নতুন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু আসল গল্প জানার জন্য সে একমাত্র পথ — নীলাঞ্জনার কাছে যাওয়াই।

পরদিন সন্ধ্যায় অভি আবার সেই পাহাড়ি ঝরনার ধারে পৌঁছালো।
নীলাঞ্জনা জলের ধারে বসে ছিল, চোখে মেঘলা ছায়া।
অভি চুপচাপ বসে গেল পাশে।

নীলাঞ্জনার প্রথম কথা ছিল,
“তোমার কাছে আসাটা আমার জন্য সহজ ছিল না। অনেক দিন ধরে আমি নিজেকে হারিয়ে রেখেছিলাম।”

তার চোখে জলের মত মায়া ভাসছিল।
“আমি কখনো চাইনি আমার চোখের নীল রঙটা কেউ শুধুমাত্র সুন্দর বলে দেখুক। আমার নিজের ভেতরের যন্ত্রণাও তো কেউ বুঝুক।”

নীলাঞ্জনা ধীরে ধীরে বলল,
“তাসিন ভালোবাসতো আমাকে, কিন্তু সে চায় সবকিছু নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে। সে বুঝতে পারেনি আমি স্বাধীন থাকতে চাই। আমি বাঁধা দিতে পারিনি  তাই পালিয়ে এসেছি।”

অভি বলল,
“আমি কখনো তোমার রঙের জন্য নয়, তোমার নিঃশব্দ কান্নার জন্য ভালোবেসেছি।”

নীলাঞ্জনা প্রথমবার একটুও লাজ বা দ্বিধা ছাড়াই বলল,
“আমার অনেক ভয় আছে, অভি।
ভয় যে কেউ আমাকে বুঝবে না, ভয় যে কেউ আমার পাশে থাকবে না।”

অভি তার হাতটা ধীরে ধরে ধরে বলল,
“আমি থাকব, যত দিন তোমার ভয় থাকবে।”



নীলাঞ্জনা বলল,
“আমার ছোটবেলায় আমি এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম।
তারপর থেকে আমি অনেকদিন একাকী থাকতাম, কারও চোখে আসতে ভয় পেতাম। আমার পরিবার আমাকে ঠিক মতো বুঝতেও পারেনি। আর তারপর তাসিন আমার জীবনে এলো, তার ভালোবাসা ছিল সত্যি, কিন্তু সে আমার গভীর আঘাতগুলো দেখেনি।”

অভি গভীর ভাবে শুনল, তার মনে হলো যেন নীলাঞ্জনার আঘাতগুলো তার নিজের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে।
সে বুঝল, এই মেয়েটা শুধু রঙিন চোখের মায়াবী নয়, এক জীবনের বেদনার গল্প।

সেদিন অভি আর নীলাঞ্জনা নদীর তীরে বসে রাতের তারাগুলো গুনছিল।
তারা জানতো, সামনে অনেক পথ আসবে, কিন্তু একে অপরের হাতে হাত রেখে তারা সেই পথ হাঁটবে।

অভি বলল,
“তুমি আমার নীল নদীর সেই নীল পরী, যে দুঃখ-সুখের নদী পেরিয়ে এলো। আমি তোমার সঙ্গে আছি, আজীবন।”

নীলাঞ্জনার হাসি যেন প্রথমবারের মতো সত্যি মনের থেকে বের হলো।
তার চোখে ঝলমল করলো এক নতুন আশা।













নীলাঞ্জনার মুখে প্রথমবারের মতো একটা খুশির ঝিলিক স্পষ্ট।
কিন্তু অভির মনে একটা অজানা টানাপোড়েন কাজ করছিল। তাসিনের কথা বার বার ফিরে আসছিল।
সে জানত, তাসিনের হারানো ঠিক নয়, ওর ফিরে আসারও সম্ভাবনা আছে।

এক বিকেলে, ঝরনার ধারে তারা দুজনে বসে আকাশের রঙের খেলায় মগ্ন ছিল, হঠাৎ ফোনে একটা অজানা নাম তার সামনে এল — তাসিন।
অভি সজাগ হয়ে উঠল, আর নীলাঞ্জনা কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ল।



তাসিন বলল,
“আমি বুঝতে পারছি আমার ভুল ছিল, আমি ফিরে এসেছি… নীলাঞ্জনা, আমাকে আবার শোনো।”

নীলাঞ্জনা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল, ওর মনে একটা জটিলতার সৃষ্টি হলো।
অভি চুপ থেকে শুধু তাকে ধীরে ধীরে দেখছিল।



অভির মনে হচ্ছিল, সে নীলাঞ্জনার জন্য যতোটা ভালো চায়, তার চাইতেও বেশি প্রয়োজন নীলাঞ্জনার মানসিক শান্তি।
সে বুঝতে পারল, তাকে নিজেকে পেছনে সরিয়ে নিতে হবে, যেন নীলাঞ্জনা নিজের মতো করে ঠিকমতো জীবন গড়তে পারে।

অভি একান্তভাবে নীলাঞ্জনার কাছে গেল এবং বলল,
“আমি তোমার জীবনে শান্তির বাতাস আনার চেষ্টা করবো, কিন্তু যদি কখনো তুমি নিজেকে হারিয়ে যাও, আমি থাকবো তোমার পাশে।”



নীলাঞ্জনার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু এবার তা বিষাদের নয়, মুক্তির।
সে বলল,
“আমি জানি, আমি এখনও ভীত, কিন্তু তোমার মতো কেউ আমার পাশে থাকলে আমি সাহস পাই।”

দুজনের মধ্যকার বন্ধন আরও গভীর হলো।
তারা জানতো, প্রেম মানেই শুধু সুখ নয়, কষ্টেরও এক অধ্যায় থাকতে হয়।





দিনগুলি ক্রমে ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল।
অভি আর নীলাঞ্জনা মেলামেশা বাড়ালেও তাসিনের ফেরার খবর তাদের মনে একটা অচেনা চাপ তৈরি করেছিল।

এক বিকেলে অভি জানতে পারে, তাসিন আসলে নীলাঞ্জনার জীবনে শুধু প্রেমিক ছিল না, তার পেছনে একটা বড় রং বেরঙের ব্যবসার অংশীদার ছিল।
নীলাঞ্জনার ওপর তার আগ্রহ শুধু ভালোবাসা ছিল না, বরং এক ধরনের ক্ষমতার ছায়া।



নীলাঞ্জনা তাসিনের সঙ্গে কথা বলল যখন সে এল।
“তুমি কেন এসেছো?”
তাসিন মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলল, “আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনি, তবে শুধু ভালোবাসার জন্য না, একটা বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে।”

নীলাঞ্জনা বুঝতে পারল, তাসিনের কথার পেছনে একটা বড় অন্ধকার লুকিয়ে আছে।
সে ভয় পেল, অভির জন্যও ঝুঁকি হতে পারে।



অভি নির্ধারিত করে নীলাঞ্জনাকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হতে।
তাদের মধ্যে একটি অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করতে লাগল — যেখানে ভালোবাসার সঙ্গে নিরাপত্তার লড়াই শুরু হল।




নীলাঞ্জনা একদিন случайত পুরনো একটা চিঠি পায়, যা তার বাবার থেকে আসা।
চিঠিতে লেখা ছিল তার পরিবারের গোপন কাহিনী, যেখানে উঠে আসে তাসিনের আসল সম্পর্ক, শুধু প্রেমিক নয়, বরং একটা বড় সখ্য।



নীলাঞ্জনা বুঝতে পারে, তার পরিবারের সাথে তাসিনের সম্পর্ক অনেক জটিল।
তাসিনের পেছনে আছে আরেক গোপন সত্তা, যা তার জীবনের অনেক অন্ধকার কথা খুলে দিতে পারে।



অভি যখন এই গোপন সত্য জানে, তখন তার মনে হয় নীলাঞ্জনার পাশে থাকা আরো কঠিন হয়ে উঠবে।
সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই গোপন রহস্য সামনে নিয়ে এসে সব কিছু স্পষ্ট করতে হবে।



নীলাঞ্জনা আর অভি একসাথে বসে ঠিক করল, তারা এই গোপন সত্যের মুখোমুখি হবে।
তাদের সম্পর্কের পরিক্ষা এখন শুরু, যেখানে বিশ্বাস আর ভালোবাসার নতুন অধ্যায় লেখা হবে।




নীলাঞ্জনা আর অভি মিলে গোপন চিঠির সূত্র ধরে তাসিনের অতীত জানার চেষ্টা করল।
তারা জানল তাসিন শুধু ভালোবাসার জন্য নয়, ব্যবসায়িক এক সংঘবদ্ধ দলের সঙ্গে যুক্ত, যারা নীলাঞ্জনার পরিবারের সম্পত্তি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।



নীলাঞ্জনা নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে চায়, কিন্তু তাসিনের বিশ্বাসঘাতকতা তার মন ভেঙে দিয়েছে।
অভি সাহস যোগায় বলল,
“আমরা একসাথে থাকব, সব বাধা পেরিয়ে।”



নীলাঞ্জনা তার নিজের শক্তি খুঁজে বের করল।
সে ঘোষণা করল,
“আমি আর কোনো ছায়ার মধ্যে বাঁচব না। নিজের মতো করে জীবন কাটাব।”



অভি ও নীলাঞ্জনা একসাথে জীবন গড়ার সিদ্ধান্ত নিল।
তারা বুঝল, ভালোবাসা মানে শুধু সুখ নয়, সংগ্রাম আর বিশ্বাসও।












নীলাঞ্জনা আর অভি মিলে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করল।
তারা নিজের জীবনের পুরনো ব্যাথা আর শঙ্কা পেছনে ফেলে সামনে এগোতে চাইল।

অভি সবসময় নীলাঞ্জনার পাশে দাঁড়াল,
“তুমি একা নও, আমি আছি।”
নীলাঞ্জনার চোখে আবার ফিরে এল আত্মবিশ্বাসের আলো।
সে শপথ করল, আর কেউ তাকে ভেঙে ফেলতে পারবে না।

তাসিন বুঝতে পারল, নীলাঞ্জনা তার থেকে দূরে সরে গেছে।
সে এবার তার পরিকল্পনা শক্ত করার জন্য নতুন কৌশল নিয়েছে, যা নীলাঞ্জনা ও অভির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।



যদিও জীবন কঠিন, ভালোবাসার শক্তি সব বাধা পার হতে পারে।
নীলাঞ্জনা ও অভি সেটাই প্রমাণ করতে চায়।



নীলাঞ্জনা আর অভির শান্তি কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল।
তাসিনের নতুন কৌশল শুরু হলো, যা ছিল নিঃসন্দেহে তাদের জীবনে নতুন ঝুঁকি নিয়ে আসার ইঙ্গিত।


তাসিন তার সহযোগীদের মাধ্যমে নীলাঞ্জনা ও অভির গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে লাগল।

তার উদ্দেশ্য ছিল তাদের দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করে খেলা চালানো।

অভি নীলাঞ্জনাকে সতর্ক করল,
“তাসিন ছাড় দেবে না, আমাদের একসাথে থাকতে হবে, প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।”

নীলাঞ্জনা এবার ভয় পায়নি,
“আমার নীল চোখ শুধু রং নয়, এতে শক্তি আছে। আমি লড়াই করব, যত দিন আমার পাশে তুমি আছো।












নীলাঞ্জনা আর অভি এখন পুরোপুরি একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল।
তাদের মধ্যে বিশ্বাস আর ভালোবাসার শক্তি ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
তাসিনের ষড়যন্ত্র যতই বড় হোক, তারা মিলেমিশে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।



অভি তার টেকনিক্যাল দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তাসিনের চালাকি ফাঁস করতে শুরু করল।
নীলাঞ্জনা তার আত্মবিশ্বাস ও সাহস দিয়ে নতুন পথে এগিয়ে গেল।



নীলাঞ্জনা বুঝতে পারল, নিজের শক্তি ও সঠিক সাহসের মাধ্যমে সে জীবনের সকল বাধা পার করতে পারে।
অভি ও নীলাঞ্জনার বন্ধন আরও মজবুত হল।



নীলাঞ্জনা আর অভি যখন নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে নিচ্ছিল, তখন তাসিনের চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
তাসিন এবার এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা তাদের জীবন পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে।



নীলাঞ্জনা ও অভি একসঙ্গে লড়ে গেল।
তাদের ভালোবাসা ছিল যেন এক মজবুত প্রাচীর, যা ভাঙতে পারে না কোনো ষড়যন্ত্র।

বিপদের মাঝেও তারা তাদের স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখল।
নীলাঞ্জনার চোখে আবার জ্বলে উঠল নতুন দিনের আলো।



নীলাঞ্জনা আর অভি সব প্রতিকূলতা জয় করে আজ সেই স্বপ্নীল সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে।
সূর্য ডোবার আলোতে যেন রক্তিম রঙ ছড়িয়ে পড়ছিল, ঠিক যেন তাদের হৃদয়ের স্পন্দন।



অভি ধীরে ধীরে নীলাঞ্জনার হাতটা ধরে বলল,
“তুমি আমার জীবনের আলো, আমার নীল আকাশের নীলপরী। তোমার ভালোবাসা ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”

নীলাঞ্জনার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু সেটা ছিল আনন্দের, প্রেমের।
সে বলে উঠল, “অভি, তোমার হাতে হাত রেখে আমি নতুন জীবন শুরু করতে চাই, যেখানে শুধু তোমার সঙ্গে থাকব।”



সন্ধ্যার হাওয়ায়, তারা একে অপরের গালে মৃদু চুম্বন দিল।
মুহূর্তটা যেন থমকে গিয়েছিল, সময় যেন নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে।

অভি ফিসফিস করে বলল,
“তুই আমার নীলপরী, চিরদিন আমার সঙ্গে থাকবে, এই পৃথিবীর সব সুখ-দুঃখে।”



নীলাঞ্জনার হৃদয় ভরে উঠল প্রেমে, সে অনুভব করল জীবনের সব অন্ধকার মুছে গেছে,
শুধু অবিরাম ভালোবাসার আলোই আজ তার পাশে জ্বলছে।



তারা দুজন জীবনের নতুন পথে হাঁটতে শুরু করল, হাতে হাত রেখে, হৃদয় হৃদয় মিলিয়ে,
একসাথে গড়বে এক নতুন সুন্দর সকাল — যেখানে শুধু থাকবে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আশা।






No comments:

Post a Comment

📖 সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা

গল্পের সম্ভার ; 📖 সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা ✦ ১ম পর্ব :  নতুন ঠিকানায়, নতুন গল্পে মেহরিন ক্লাস নাইনে নতুন ভর্তি হয়েছে শহরের বিখ্যাত ‘বিকাশ ব...