📖 উপন্যাস: "তোমার অপেক্ষায়"

গল্পের জগত ;

📖 উপন্যাস: "তোমার অপেক্ষায়"

---

📖 উপন্যাস: "তোমার অপেক্ষায়"

অধ্যায় ১: নীলচে বিকেলের মুখোমুখি

সায়েমের বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, সফল একজন স্থপতি। শহরের উঁচু বিল্ডিংগুলোর নকশার পেছনে তার নিঃশব্দ হাতের ছোঁয়া। জীবনের বাইরে থেকে দেখে অনেকেই ভাবে, তার সব আছে—প্রতিষ্ঠা, প্রতিভা, অর্থ। কিন্তু ভেতরের মানুষটা নিঃসঙ্গ। তার জীবনে কেউ নেই যার সাথে সন্ধ্যা নামার সময় অভিমান করে চা খেতে পারে, কিংবা নিঃশব্দে ভালোবাসা ভাগ করে নিতে পারে।

একদিন, বসুন্ধরায় একটি নতুন প্রজেক্টের কাজ হাতে নেয় সে। ক্লায়েন্ট চায়, প্রজেক্টে একটি আর্ট গ্যালারি থাকুক, শহরের ভিড়ের মধ্যে একটুকরো শান্তির মতো। সেখানে প্রথম পরিচয় আনিকার সাথে। সাদা শাড়ির উপর হালকা নীল আঁচল, চোখে গভীর দৃষ্টি—আনিকা যেন অন্য এক দুনিয়ার মানুষ।

“আপনার নকশা চমৎকার,” আনিকা বলেছিল প্রথমবারেই।
সায়েম থমকে গিয়েছিল, এমন প্রশংসা সে অনেক পেয়েছে, কিন্তু এই কথায় ছিল কিছু অতিরিক্ত—কথার ভেতরে একটা দৃষ্টি, যেন তাকে চিনে ফেলার চেষ্টা করছে।

অধ্যায় ২: কিছু না বলেও বলা

পরের দিনগুলোতে একসাথে বসে কাজ করতে করতে তাদের সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। আনিকার আর্ট, সায়েমের ডিজাইন—দুটো একসাথে মিলে এক নতুন ভাষা সৃষ্টি করে।
আনিকা বলত, “স্থাপত্য স্থির শিল্প, আর্ট চলমান,” আর সায়েম হাসত, “তোমার আঁকা ছবির ভেতরেই আমি ভবিষ্যতের শহর দেখি।”

তাদের কথায় গল্প হতো, গল্পে থাকত হাসি, মাঝে মাঝে অকারণ নীরবতা। সেই নীরবতায় ভালোবাসার স্পর্শ ছিল।

এক সন্ধ্যায়, ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে তারা সূর্যাস্ত দেখছিল। হঠাৎ সায়েম জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি জানো, এই সময়টায় তোমাকে দেখে আমার ভয় হয়?”
আনিকা অবাক, “ভয়? কেন?”
“কারণ, এই আলোয় তুমি স্বপ্নের মতো দেখাও… আমি ভাবি, তুমি হারিয়ে যাবে।”

আনিকার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু সে কিছু বলল না। তার কণ্ঠে ছিল কেবল নিঃশব্দ কবিতা।

অধ্যায় ৩: ভালোবাসা এবং দূরত্বের প্রথম চিঠি

যখন সম্পর্কটা ঠিক যেন বুঝে ওঠার মুখে, তখনই ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত কিছু। আনিকার বাবা স্ট্রোক করেন। কলকাতার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লাগে। সে রাতেই আনিকা চলে যায়।

সায়েম কিছু বলতে চেয়েও পারে না। শুধু বলে, “যাবে, কিন্তু ফিরবে তো?”
আনিকা বলে, “তুমি কী চাও?”
সায়েম বলে, “তোমার অপেক্ষা করতে পারি… যদি জানি তুমি একদিন ঠিক ফিরে আসবে।”
আনিকা হাসে, “তাহলে আমি আসবই।”

এরপর শুরু হয় অপেক্ষা। প্রথম কয়েক সপ্তাহ ফোনে কথা হয়, তারপর সেটা কমতে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ একটা মেসেজ, “আজ ডাক্তার বলেছে নতুন পরীক্ষা লাগবে”, “বাবা কথা বলতে পারছেন না এখনো”, “মাফ করো, ফোন ধরতে পারিনি”…

সায়েম বুঝে, ভালোবাসা এখন শুধু শব্দে নেই, সে আছে নিঃশ্বাসের মধ্যে—একটানা এক দুঃসহ অপেক্ষা।

অধ্যায় ৪: হারিয়ে যাওয়ার ভয়

এক বছর পেরিয়ে যায়।

সায়েম ততদিনে অন্য এক প্রজেক্টে চলে গেছে। জীবন চলছে—কাজ, রাতের নিঃশব্দতা, আনিকার আঁকা ছবির প্রতিচ্ছবি তার দেয়ালে।

এদিকে আনিকা কলকাতায় বাবাকে হারিয়ে ফেলে। সেই শোক, একাকীত্ব, আর্থিক সংকট—সবকিছু সামলে, সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার ফিরতে হবে।

একদিন, চুপচাপ এসে দাঁড়ায় সেই পুরোনো ভবনের সামনে। অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, সায়েম এখন আর এখানে নেই।
সে এক লিফটে ওঠে, ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়—যেখান থেকে একদিন সূর্যাস্ত দেখে বলেছিল, “ভয় হয় তুমি হারিয়ে যাবে।”

সেই ভয় আজ বাস্তব।

অধ্যায় ৫: পুনর্মিলন—এক চুম্বনের অপেক্ষা

শেষমেশ ফোন করে সায়েমকে। প্রথমে ফোন বেজে যায়, পরে সায়েম ধীরে ধীরে কণ্ঠে বলে, “কে?”
এক মুহূর্ত নীরবতা… তারপর—
“আমি… আনিকা।”

দুপুরে তারা দেখা করে সেই পুরোনো কফিশপে। দুই কাপ চা, এক বছরের নীরবতা ভেঙে আনিকা বলে,
“আমি জানি না, তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো কিনা। কিন্তু আমার ভালোবাসাটা থেমে যায়নি।”

সায়েম একটু সময় নেয়। তারপর ধীরে ধীরে উঠে আনিকার পাশে এসে বসে, তার হাত ধরে।

“তোমার অপেক্ষা করতে করতে আমি শিখে গেছি, ভালোবাসা মানে শুধু কাছাকাছি থাকা নয়—ভালোবাসা মানে ফিরে আসবে এই বিশ্বাসে বেঁচে থাকা। তুমি ফিরেছো। এতেই সব বলা হয়ে গেছে।”

আনিকা তখন তার কাঁধে মাথা রাখে। শহরের কোলাহলের ভেতরেও সেই মুহূর্তে ছিল এক নিঃশব্দ পৃথিবী—যেখানে কেবল দুইটা হৃদয় কথা বলছিল।

---

শেষ অধ্যায়: তোমার অপেক্ষায়

তারা আবার একসাথে থাকতে শুরু করে। সায়েমের বাসায় আনিকার আঁকা ছবি, আনিকার রান্নায় সায়েমের সকাল, ছুটির দিনে নকশা আর স্কেচ—সব মিলে গড়ে ওঠে নতুন একটা পৃথিবী।

যেখানে ভালোবাসা ছিল না নাটকীয়, বরং ছিল ধীরে ধীরে গভীর হয়ে ওঠা সম্পর্ক।
তারা বুঝেছে—ভালোবাসা শুধু বলার বিষয় নয়, সেটা সময়ের সাথে গঠিত এক অদৃশ্য বন্ধন। অপেক্ষা, বিশ্বাস আর ফিরে আসার গল্প—এই ভালোবাসা।

---