গল্পের সম্ভার ;
📖 সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা
✦ ১ম পর্ব :
নতুন ঠিকানায়, নতুন গল্পে
মেহরিন ক্লাস নাইনে নতুন ভর্তি হয়েছে শহরের বিখ্যাত ‘বিকাশ বিদ্যাপীঠ’ স্কুলে। ঢাকার ব্যস্ততা থেকে বাবা বদলি হয়ে মফস্বলে চলে আসার পর এই স্কুলটাই তার জন্য নতুন পৃথিবী। মেহরিন একটু চুপচাপ, বইপড়ুয়া মেয়ে—বন্ধুর থেকেও ডায়রি তার বেশি আপন।
প্রথম দিন- মেহরিন অনেক বেশি আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত ছিল।নতুন স্কুল নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু বান্ধবী। সবকিছু নিয়ে মেহরিন অনেক বেশি খুশি ছিল ।এসব চিন্তা করতে করতে মেহরিন স্কুলের গেটের সামনে ধাক্কা খায় একটা সাইকেলের সঙ্গে।মেহরিন পড়ে যায় ও ব্যথা পায়, আর খুবই বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
— "দেখেন না? লোকজনের ওপর সাইকেল উঠিয়ে দিচ্ছেন?" — বিরক্ত মেহরিন।
— "আর আপনি কি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে গিয়ে দাঁড়ান, — ছেলেটা মুচকি হেসে বলে।
সে ছেলেটার নাম রুদ্র।
স্কুলের সবচেয়ে দুরন্ত আর খামখেয়ালি ছাত্র। সব শিক্ষক-শিক্ষিকা জানেন—ওর পেছনে বসলে কেউ পড়ালেখা শেখে না, হাসাহাসি আর দুষ্টুমিতে ব্যস্ত থাকে। তাদের আর পড়ালেখা হয় না।
রুদ্র ক্লাসের একদম শেষ বেঞ্চে বসে। মেহরিন প্রথম দিন থেকেই প্রথম বেঞ্চে। কিন্তু টিফিন পিরিয়ডে, করিডোরে, লাইব্রেরির লাইনে—প্রায়ই মুখোমুখি হয় তাদের।রুদ্র তখন থেকেই মেহরিনকে বিরক্ত করা শুরু করে।কখনো কাগজ ছুঁড়ে দেয়, কখনও পেনসিল চুরি করে নেয়, কখনও চুল টেনে বলে,
— “তুমি না ক্লাসের সবচেয়ে বোরিং মেয়ে!"
মেহরিন সারাদিন চুপচাপ ছিল। আগের রাতে মা-বাবার ঝগড়াটা আজও তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
স্কুলের লাইব্রেরিতে গিয়ে সে বসে পড়েছিল প্রিয় কোণটাতে, জানালার পাশে, যেখান থেকে আকাশটা দেখা যায়। চোখে জল চলে এসেছিল—অথচ কেউ তা দেখুক, তা সে চায় না।অনেকটা লুকিয়ে ডাইরি লিখছিল ও কাঁদছিল।
হঠাৎ রুদ্র দূর থেকে দেখে, লাইব্রেরীতে বসে মেহরিন কি যেন করছে।রুদ্র সামনে এগিয়ে এসে মেহরিনকে জিজ্ঞেস করল, কি করছো তুমি। মেহরিনের হঠাৎ চোখ পড়ে যায় রুদ্রের দিকে। রুদ্রও তার দিকে তাকিয়ে থাকে, রুদ্র দেখে মেহেরিনের চোখ ছল ছল করছে। মেহেরিনের চোখে পানি দেখে রুদ্র কেমন যেন নিরব হয়ে গিয়েছিল। মেহেরিনের প্রতি মায়া হল তার। কিছু একটা চিন্তা করে ওকে হাসানোর চেষ্টা করলো।
— “তুমি কাঁদলে তোমার এইচএসসি নম্বর কমে যাবে।”বললো রুদ্র।
— “তুমি যাও তো... আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”বিরক্ত হলো মেহরিন।
রুদ্র একটু নরম সুরে বলল,
— “তুমি জানো? যারা কাঁদতে জানে, তারা ভালোবাসতেও জানে।”
মেহরিন কোনো উত্তর দিল না। শুধু মাথা নিচু করে বসে রইল।
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর উঠে চলে গেল। পরের দিন ক্লাসে মেহরিন যখন একটু বাহিরে গিয়েছিলো সেই সুযোগে রুদ্র একটা চিঠি তার ব্যাগে রেখে দিল।
ক্লাসে গণিতের স্যার আসলো, মেহেরিন ক্লাস করার জন্য ব্যাগ থেকে যখনি খাতা বের করতে গেল , তখন ও খেয়াল করল ওর খাতার উপরে ভাঁজ করা একটা কাগজ। ক্লাসে স্যার থাকায় মেহেরিন তখন কাগজটি খুলে দেখেনি।
ক্লাস শেষে মেহেরিন লাইব্রেরীতে গিয়ে কাগজটি খুলে দেখলো।
✦ দ্বিতীয় পর্ব:
*“প্রিয় বোরিং মেয়ে,
তোমার চোখে দুঃখ দেখলে আমার হাসি পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
আমি খামখেয়ালি হতে পারি, ডিস্টার্বিং হতে পারি,
কিন্তু কারও চোখে জল দেখতে পারি না... বিশেষ করে তোমার চোখে।
তোমার চুলে পেন্সিল ঢুকিয়ে দুষ্টুমি করি ঠিকই,
কিন্তু জানো? ওই মুহূর্তগুলোই আমার প্রিয়।
তুমি রেগে যাও, আমি হেসে যাই।
তুমি চুপ করে থাকো, আমি ভেতরে ভেতরে তোমার গল্প লিখি।
তুমি জানো না, তুমি আমার প্রতিদিনের সবচেয়ে সুন্দর ভুল।
— রুদ্র”**
মেহরিন চমকে ওঠে।
চিঠিটা কি সত্যি? এটা কি মজা, না...?
তার মন কাঁপতে থাকে। কিছু একটা ধীরে ধীরে গলতে থাকে তার ভেতরে।
রুদ্রের সেই চঞ্চল চোখের আড়ালে কি সত্যিই একটা স্পর্শকাতর হৃদয় লুকিয়ে আছে?
মেহেরিন ডায়রির নতুন পাতায় একটা প্রশ্ন লেখে—
“সে কি সত্যিই আমাকে একটু… পছন্দ করে?”
চিঠিটা পেয়ে মেহরিন অনেক বেশি উচ্চশিত হয়। সেও রুদ্রকে ভালবাসতে শুরু করে।সে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে আর মনে মনে চিন্তা করে কেউ একজন মনে হয় ওকে অনেক বেশি ফলো করে।যেটা ভালো লাগতে শুরু করে মেহরিনের।পরের দিন মেহরিন স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হল। আজকে ও একটু সেজেগুজে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হল। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে একটু কাজল, এটুকুতেই ওকে যেন পরীর মত লাগছিল। স্কুলের গেট দিয়ে যখন ঢুকছে তখন খুব লজ্জা পাচ্ছিল মেহেরিন।
রুদ্র না আবার সামনে পড়ে যায় -মনে মনে ভাবলো মেহেরিন।
মেহেরিন যখন ক্লাসে ঢুকবে ঠিক সেই মুহূর্তেই রুদ্র ক্লাস থেকে বের হচ্ছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দুজনের অনেক জোরে ধাক্কা লাগে, মেহেরিনের গায়ের উপর পড়ে যায় রুদ্র।
এই প্রথম কোন মেয়ের শরীরের স্পর্শ পেল রুদ্র। সেই স্পর্শ রুদ্রকে যেন পাগল করে দিচ্ছিল। আর তার সাথে তার সুন্দর সুন্দর গোলাপী ঠোঁটগুলো যেন তাজা একটি গোলাপ ফুল হয়ে ফুটে আছে।
এক্ষুনি আদর করতে মন চাইছিল।
অপলক বৃষ্টিতে রুদ্র তাকিয়ে আছে মেহেরিনের দিকে।
ক্লাসের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে সেদিকে খেয়ালই নেই রুদ্রের।
তখনই মেহেরিন ডেকে বলল -এই উঠো সবাই দেখছে আমাদেরকে " বলে রুদ্রকে একটা ধাক্কা দিল।
রুদ্র তখনই তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ল আর মেহেরিনকে টেনে তুলল।
""এই সরি সরি আমি ইচ্ছে করে ফেলে দিইনি;-বলল রুদ্র।
মেহেরিন কিছু না বলেই ওর বেঞ্চে গিয়ে বসলো।
ঐদিন একটিবারের জন্যও রুদ্র মেহেরিনের থেকে চোখ ফেরায় নি। পুরো ক্লাস জুড়ে শুধু মেহেরিনকে দেখেছে।
মেহরিন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করল।
✦ তৃতীয় পর্ব:
স্কুলের সকালটা অন্য রকমভাবে শুরু হলো। আজ ক্লাস টেস্ট—বাংলা প্রথম পত্র।
মেহরিন যথারীতি প্রথম বেঞ্চে। সব উত্তর মুখস্থ, সব গুছানো।
রুদ্র? সে ক্লাসে ঢুকল পেছনের দরজা দিয়ে, হালকা ঘুমঘুম চোখে, হাতে একটা খালি খাতা।
কেউ একজন বলল — “রুদ্র, বই তো আনো নাই?”
— “বই তো পরীক্ষার জন্য লাগে না, উত্তর তো বন্ধুদের থেকে আসবে।” — বলে হেসে ফেলল রুদ্র।
মেহরিন তাকিয়ে রইল চুপচাপ।
পরীক্ষা শুরু হলো। সবাই লিখছে। হঠাৎ মেহরিন টের পায়, পেছন থেকে রুদ্র তার বেঞ্চে কিছু গুঁজে দিয়েছে—একটা ছোট কাগজ।
ঠিক তখনই প্রবেশ করলেন বাংলা ম্যাডাম।
ম্যাডাম গম্ভীর হয়ে বললেন,
— “তুমি কী করছ রুদ্র?”
— “আমি... আমি…” — রুদ্র থমকে যায়।
ম্যাডাম তার খাতা খুলে দেখে একটা ভাঁজ করা কাগজ—
তাতে লেখা:
"প্রশ্ন ৩: প্রিয় ঋতুর বর্ণনা (সৃজনশীল প্রশ্ন)"
আর নীচে লেখা মেহরিন-এর হাতের লেখায় সাজানো উত্তরের সারাংশ!
ম্যাডাম চিৎকার করে উঠলেন,
— “তুমি টুকলি করছ? তো বড় সাহস কই পেল রুদ্র?”
রুদ্র কিছু বলে না।
পুরো ক্লাস চুপচাপ।
তখন হঠাৎ মেহরিন দাঁড়িয়ে পড়ে।
নির্ভীক কণ্ঠে বলে,
— “স্যার, ওটা আমি দিয়েছি। ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বিশ্বাস করেছিলাম ও কপি করবে না।”
ম্যাডাম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।
তারপর বলেন,
— “ভবিষ্যতে এসব আর যেন না হয়।”
বাঁচল রুদ্র। কিন্তু তার চেয়ে বড় ব্যাপার, মেহরিন আজ তার হয়ে কথা বলল।
পরীক্ষা শেষে রুদ্র মেহরিনের কানে কানে বলল,
— “তোমাকে একটা উপহার দেব।”
— “উপহার?”
— “হ্যাঁ, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা…”
স্কুল ছুটির পরে রুদ্র তার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করলো।
তার ভেতরে ছোট ছোট কিছু লেখা, আঁকা কিছু ছবির মতো স্মৃতি।
এক পাতায় লেখা:
“তোমাকে দেখে আমার প্রথম ভালো লাগা শুরু হয়েছিল, যখন তুমি আমাদের স্কুলের ভর্তি হওয়ার জন্য এসেছিলে । আমি অপলক দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।অদ্ভুত এক মায়াছিল তোমার সেই মুখে আর সেই দিন থেকে আমার খামখেয়ালির শুরু। আজ তোমাকে দিলাম আমার খামখেয়ালি মনে রাখা ডায়েরিটা।”
মেহরিন একবার তাকাল রুদ্রের দিকে।
প্রথমবার সে কিছু বলল না। কিন্তু তার চোখে ছিল এমন এক চাহনি, যেটা শব্দে বোঝানো যায় না।
✦ চতুর্থ পর্ব:
মেহরিন সেই রাতটা ঘুমাতে পারেনি।
রুদ্রের দেওয়া পুরনো ডায়েরিটা নিয়ে বসেছিল সে—নীলাভ কাভারে হাতের লেখা, কিছু জায়গায় জল পড়া দাগ, আর পাতায় পাতায় পাগলামির ছাপ। কিন্তু প্রতিটি পৃষ্ঠায় লুকিয়ে আছে এক গভীর ভালোবাসা, এক খামখেয়ালি হৃদয়ের আত্মপ্রকাশ।
প্রথম পাতায় লেখা—
“এই ডায়েরি তার জন্য, যে আমার পৃথিবীতে এসে সব এলোমেলো করে দিয়েছে।
আমি হয়তো কখনও সাহস করে বলব না,
কিন্তু লিখে যাব... যতদিন মনে থাকবে।
তার নাম—মেহরিন।”
মেহরিনের বুক কেঁপে উঠল। সে কখনও কল্পনাও করেনি যে রুদ্র তাকে এতদিন ধরে এত গভীরভাবে দেখছে, অনুভব করছে।
প্রতিটি পাতায় লেখা—
-
কখন সে প্রথম চুল খুলে এসেছিল স্কুলে
-
কোন দিনে সে কাঁদছিল করিডোরে দাঁড়িয়ে
-
কোন রংয়ের ওড়না পরলে তাকে “একটু বেশিই সুন্দর” লাগে
-
এবং একটা পাতায় লেখা ছিল—
“যদি কোনোদিন সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, আমি আমার সব খামখেয়ালিপনা ছেড়ে দেব।”
সেই রাতেই মেহরিন ডায়েরির শেষ পাতায় একটা নতুন লেখা যোগ করল, পেন্সিল দিয়ে—
“আজ প্রথমবার, আমি ওর চোখে সত্যি একজন আপন মানুষকে দেখেছি।
ওর ডায়েরিটা যেন আমার ‘নিজেকে ফিরে পাওয়ার আয়না’।
হয়তো, আমি এতদিন ওকে ভুল বুঝেছি।
হয়তো আমি ভালোবেসে ফেলেছি ওর খামখেয়ালিপনাকে।”
পরদিন স্কুলে আসতেই একটা গুঞ্জন—
“রুদ্র-মেহরিন প্রেম করছে!”
“ডায়েরি দিয়ে প্রেম প্রপোজাল!”
“মেহরিন নাকি এখন রুদ্রের সঙ্গে টিফিন করে!”
মেহরিন চুপচাপ সোজা চলে যায় ক্লাসে। কিন্তু সহ্য করতে পারে না যখন দু-তিন জন মেয়ে এসে বলে,
— “তুইও না! এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়লি?”
— “ও তো একটা উড়নচণ্ডী... তোর মতো মেয়ে ওর সঙ্গে যায়?”
রুদ্র জানে এইসব কথা কেমন কষ্ট দেয়। সে চুপচাপ এসে মেহরিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে—
— “তুই চাইলে আমি পুরো স্কুলকে বলব, আমরা শুধু বন্ধু।”
— “তুই চাইলে আমি স্কুলটাই ছেড়ে দেব।”
— “কিন্তু আমি চাই, তুই যা বলবি, সেটা মন থেকে বলিস। ভয় পেয়ে না।”
মেহরিন এবার প্রথমবার তার দিকে তাকিয়ে বলে—
— “আমি কিছুই লুকাব না।
আমার বন্ধুত্ব তোকে দিয়েছে হৃদয়ের স্পর্শ।
আর যদি কিছু শুরু হয়, সেটা সবাই দেখুক,
কারণ তুই আমার খামখেয়ালি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সত্যি।”
রুদ্র চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ,
তারপর বলল—
— “তোর কথায় মন ভালো হয়ে যায় রে, বোরিং মেয়ে।”
— “আমি বোরিং? তাহলে তুই তো পুরো নাটক।”
— “তুই আমার গল্পের প্রথম পাতায় লেখা নাম।”