Sunday, June 22, 2025

📖 সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা

গল্পের সম্ভার ;




📖 সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা


✦ ১ম পর্ব : 

নতুন ঠিকানায়, নতুন গল্পে

মেহরিন ক্লাস নাইনে নতুন ভর্তি হয়েছে শহরের বিখ্যাত ‘বিকাশ বিদ্যাপীঠ’ স্কুলে। ঢাকার ব্যস্ততা থেকে বাবা বদলি হয়ে মফস্বলে চলে আসার পর এই স্কুলটাই তার জন্য নতুন পৃথিবী। মেহরিন একটু চুপচাপ, বইপড়ুয়া মেয়ে—বন্ধুর থেকেও ডায়রি তার বেশি আপন।
প্রথম দিন- মেহরিন অনেক বেশি আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত ছিল।নতুন স্কুল নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু বান্ধবী। সবকিছু নিয়ে মেহরিন অনেক বেশি খুশি ছিল ।এসব চিন্তা করতে করতে   মেহরিন  স্কুলের গেটের সামনে ধাক্কা খায় একটা সাইকেলের সঙ্গে।মেহরিন পড়ে যায় ও ব্যথা পায়, আর খুবই বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। 
— "দেখেন না? লোকজনের ওপর সাইকেল উঠিয়ে দিচ্ছেন?" — বিরক্ত মেহরিন।
— "আর আপনি কি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন,  পাশে গিয়ে দাঁড়ান,  — ছেলেটা মুচকি হেসে বলে।
সে ছেলেটার নাম রুদ্র
স্কুলের সবচেয়ে দুরন্ত আর খামখেয়ালি ছাত্র। সব শিক্ষক-শিক্ষিকা জানেন—ওর পেছনে বসলে কেউ পড়ালেখা শেখে না, হাসাহাসি আর দুষ্টুমিতে ব্যস্ত থাকে। তাদের আর পড়ালেখা হয় না। 
রুদ্র ক্লাসের একদম শেষ বেঞ্চে বসে। মেহরিন প্রথম দিন থেকেই প্রথম বেঞ্চে। কিন্তু টিফিন পিরিয়ডে, করিডোরে, লাইব্রেরির লাইনে—প্রায়ই মুখোমুখি হয় তাদের।রুদ্র তখন থেকেই মেহরিনকে বিরক্ত করা শুরু করে।কখনো  কাগজ ছুঁড়ে দেয়, কখনও পেনসিল চুরি করে নেয়, কখনও চুল টেনে বলে,
— “তুমি না ক্লাসের সবচেয়ে বোরিং মেয়ে!"
মেহরিন সারাদিন চুপচাপ ছিল। আগের রাতে মা-বাবার ঝগড়াটা আজও তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
স্কুলের লাইব্রেরিতে গিয়ে সে বসে পড়েছিল প্রিয় কোণটাতে, জানালার পাশে, যেখান থেকে আকাশটা দেখা যায়। চোখে জল চলে এসেছিল—অথচ কেউ তা দেখুক, তা সে চায় না।অনেকটা  লুকিয়ে ডাইরি লিখছিল ও কাঁদছিল। 
হঠাৎ রুদ্র দূর থেকে দেখে, লাইব্রেরীতে বসে মেহরিন কি যেন করছে।রুদ্র সামনে এগিয়ে এসে মেহরিনকে জিজ্ঞেস করল, কি করছো তুমি। মেহরিনের হঠাৎ  চোখ পড়ে যায় রুদ্রের  দিকে। রুদ্রও তার দিকে তাকিয়ে থাকে, রুদ্র দেখে মেহেরিনের চোখ ছল ছল করছে। মেহেরিনের চোখে পানি দেখে রুদ্র কেমন যেন নিরব হয়ে গিয়েছিল। মেহেরিনের প্রতি মায়া হল তার। কিছু একটা চিন্তা করে ওকে হাসানোর চেষ্টা করলো। 
— “তুমি কাঁদলে তোমার  এইচএসসি নম্বর কমে যাবে।”বললো রুদ্র। 
— “তুমি যাও তো... আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”বিরক্ত হলো মেহরিন। 
রুদ্র একটু নরম সুরে বলল,
— “তুমি জানো? যারা কাঁদতে জানে, তারা ভালোবাসতেও জানে।”
মেহরিন কোনো উত্তর দিল না। শুধু মাথা নিচু করে বসে রইল।
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর উঠে চলে গেল। পরের দিন ক্লাসে মেহরিন যখন একটু বাহিরে গিয়েছিলো সেই সুযোগে রুদ্র  একটা  চিঠি তার ব্যাগে রেখে দিল। 
ক্লাসে গণিতের স্যার  আসলো, মেহেরিন ক্লাস করার জন্য ব্যাগ থেকে যখনি খাতা বের করতে গেল , তখন ও খেয়াল করল ওর খাতার উপরে ভাঁজ করা একটা কাগজ। ক্লাসে স্যার থাকায় মেহেরিন তখন কাগজটি খুলে দেখেনি।
ক্লাস শেষে মেহেরিন লাইব্রেরীতে গিয়ে কাগজটি খুলে দেখলো।


✦ দ্বিতীয় পর্ব: 


*“প্রিয় বোরিং মেয়ে,
তোমার চোখে দুঃখ দেখলে আমার হাসি পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
আমি খামখেয়ালি হতে পারি, ডিস্টার্বিং হতে পারি,
কিন্তু কারও চোখে জল দেখতে পারি না... বিশেষ করে তোমার চোখে।
তোমার চুলে পেন্সিল ঢুকিয়ে দুষ্টুমি করি ঠিকই,
কিন্তু জানো? ওই মুহূর্তগুলোই আমার প্রিয়।
তুমি রেগে যাও, আমি হেসে যাই।
তুমি চুপ করে থাকো, আমি ভেতরে ভেতরে তোমার গল্প লিখি।
তুমি জানো না, তুমি আমার প্রতিদিনের সবচেয়ে সুন্দর ভুল।
— রুদ্র”**


মেহরিন চমকে ওঠে।
চিঠিটা কি সত্যি? এটা কি মজা, না...?
তার মন কাঁপতে থাকে। কিছু একটা ধীরে ধীরে গলতে থাকে তার ভেতরে।
রুদ্রের সেই চঞ্চল চোখের আড়ালে কি সত্যিই একটা স্পর্শকাতর হৃদয় লুকিয়ে আছে?
মেহেরিন ডায়রির নতুন পাতায় একটা প্রশ্ন লেখে—

“সে কি সত্যিই আমাকে একটু… পছন্দ করে?”

  চিঠিটা পেয়ে মেহরিন অনেক বেশি উচ্চশিত হয়। সেও রুদ্রকে ভালবাসতে শুরু করে।সে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে আর মনে মনে চিন্তা করে কেউ একজন মনে হয় ওকে অনেক বেশি ফলো করে।যেটা ভালো লাগতে শুরু করে মেহরিনের।পরের দিন মেহরিন স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হল। আজকে ও একটু সেজেগুজে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হল। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে একটু কাজল, এটুকুতেই ওকে যেন পরীর মত লাগছিল। স্কুলের গেট দিয়ে যখন ঢুকছে  তখন খুব লজ্জা পাচ্ছিল মেহেরিন। 

রুদ্র না আবার সামনে পড়ে যায় -মনে মনে ভাবলো মেহেরিন। 

মেহেরিন যখন ক্লাসে ঢুকবে ঠিক সেই মুহূর্তেই রুদ্র ক্লাস থেকে বের হচ্ছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দুজনের অনেক জোরে ধাক্কা লাগে, মেহেরিনের গায়ের উপর পড়ে যায় রুদ্র। 

এই প্রথম কোন মেয়ের শরীরের স্পর্শ  পেল রুদ্র। সেই স্পর্শ রুদ্রকে যেন পাগল করে দিচ্ছিল। আর তার সাথে তার সুন্দর সুন্দর গোলাপী ঠোঁটগুলো যেন তাজা একটি গোলাপ  ফুল হয়ে ফুটে আছে। 

এক্ষুনি আদর করতে মন চাইছিল। 

অপলক বৃষ্টিতে রুদ্র তাকিয়ে  আছে মেহেরিনের দিকে। 

ক্লাসের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে সেদিকে খেয়ালই নেই রুদ্রের। 

তখনই মেহেরিন ডেকে বলল -এই উঠো সবাই দেখছে আমাদেরকে " বলে রুদ্রকে একটা ধাক্কা দিল। 

রুদ্র তখনই তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ল আর মেহেরিনকে টেনে তুলল। 

""এই সরি সরি আমি ইচ্ছে করে ফেলে দিইনি;-বলল রুদ্র। 

মেহেরিন কিছু না বলেই ওর বেঞ্চে গিয়ে বসলো। 

ঐদিন একটিবারের জন্যও রুদ্র মেহেরিনের থেকে চোখ ফেরায় নি। পুরো ক্লাস জুড়ে শুধু মেহেরিনকে দেখেছে।


মেহরিন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করল। 













✦ তৃতীয় পর্ব:

স্কুলের সকালটা অন্য রকমভাবে শুরু হলো। আজ ক্লাস টেস্ট—বাংলা প্রথম পত্র।
মেহরিন যথারীতি প্রথম বেঞ্চে। সব উত্তর মুখস্থ, সব গুছানো।
রুদ্র? সে ক্লাসে ঢুকল পেছনের দরজা দিয়ে, হালকা ঘুমঘুম চোখে, হাতে একটা খালি খাতা।

কেউ একজন বলল — “রুদ্র, বই তো আনো নাই?”
— “বই তো পরীক্ষার জন্য লাগে না, উত্তর তো বন্ধুদের থেকে আসবে।” — বলে হেসে ফেলল রুদ্র। 

মেহরিন তাকিয়ে রইল চুপচাপ।

পরীক্ষা শুরু হলো। সবাই লিখছে। হঠাৎ মেহরিন টের পায়, পেছন থেকে রুদ্র তার বেঞ্চে কিছু গুঁজে দিয়েছে—একটা ছোট কাগজ।
ঠিক তখনই প্রবেশ করলেন বাংলা ম্যাডাম।

ম্যাডাম গম্ভীর হয়ে বললেন,
— “তুমি কী করছ রুদ্র?”
— “আমি... আমি…” — রুদ্র থমকে যায়।

ম্যাডাম তার খাতা খুলে দেখে একটা ভাঁজ করা কাগজ—
তাতে লেখা:

"প্রশ্ন ৩: প্রিয় ঋতুর বর্ণনা (সৃজনশীল  প্রশ্ন)"
আর নীচে লেখা মেহরিন-এর হাতের লেখায় সাজানো উত্তরের সারাংশ!

ম্যাডাম চিৎকার করে উঠলেন,
— “তুমি টুকলি করছ? তো বড় সাহস কই পেল রুদ্র?”
রুদ্র কিছু বলে না।

পুরো ক্লাস চুপচাপ।

তখন হঠাৎ মেহরিন দাঁড়িয়ে পড়ে।
নির্ভীক কণ্ঠে বলে,
— “স্যার, ওটা আমি দিয়েছি। ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বিশ্বাস করেছিলাম ও কপি করবে না।”

ম্যাডাম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।
তারপর বলেন,
— “ভবিষ্যতে এসব আর যেন না হয়।”

বাঁচল রুদ্র। কিন্তু তার চেয়ে বড় ব্যাপার, মেহরিন আজ তার হয়ে কথা বলল।

পরীক্ষা শেষে রুদ্র মেহরিনের  কানে কানে বলল,

— “তোমাকে একটা উপহার দেব।”
— “উপহার?”
— “হ্যাঁ, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা…”

স্কুল ছুটির পরে রুদ্র তার ব্যাগ থেকে  একটা   ডায়েরি বের করলো।
তার ভেতরে ছোট ছোট কিছু লেখা, আঁকা কিছু ছবির মতো স্মৃতি।

এক পাতায় লেখা:

“তোমাকে দেখে আমার প্রথম ভালো লাগা শুরু হয়েছিল, যখন তুমি আমাদের স্কুলের ভর্তি হওয়ার জন্য এসেছিলে । আমি অপলক দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।অদ্ভুত এক মায়াছিল তোমার সেই মুখে  আর সেই দিন থেকে আমার খামখেয়ালির শুরু। আজ তোমাকে দিলাম আমার খামখেয়ালি মনে রাখা ডায়েরিটা।”

মেহরিন একবার তাকাল রুদ্রের দিকে।

প্রথমবার সে কিছু বলল না। কিন্তু তার চোখে ছিল এমন এক চাহনি, যেটা শব্দে বোঝানো যায় না।


✦ চতুর্থ পর্ব: 

মেহরিন সেই রাতটা ঘুমাতে পারেনি।

রুদ্রের দেওয়া পুরনো ডায়েরিটা নিয়ে বসেছিল সে—নীলাভ কাভারে হাতের লেখা, কিছু জায়গায় জল পড়া দাগ, আর পাতায় পাতায় পাগলামির ছাপ। কিন্তু প্রতিটি পৃষ্ঠায় লুকিয়ে আছে এক গভীর ভালোবাসা, এক খামখেয়ালি হৃদয়ের আত্মপ্রকাশ।

প্রথম পাতায় লেখা—

“এই ডায়েরি তার জন্য, যে আমার পৃথিবীতে এসে সব এলোমেলো করে দিয়েছে।
আমি হয়তো কখনও সাহস করে বলব না,
কিন্তু লিখে যাব... যতদিন মনে থাকবে।
তার নাম—মেহরিন।”

মেহরিনের বুক কেঁপে উঠল। সে কখনও কল্পনাও করেনি যে রুদ্র তাকে এতদিন ধরে এত গভীরভাবে দেখছে, অনুভব করছে।
প্রতিটি পাতায় লেখা—

  • কখন সে প্রথম চুল খুলে এসেছিল স্কুলে

  • কোন দিনে সে কাঁদছিল করিডোরে দাঁড়িয়ে

  • কোন রংয়ের ওড়না পরলে তাকে “একটু বেশিই সুন্দর” লাগে

  • এবং একটা পাতায় লেখা ছিল—

“যদি কোনোদিন সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, আমি আমার সব খামখেয়ালিপনা ছেড়ে দেব।”

সেই রাতেই মেহরিন ডায়েরির শেষ পাতায় একটা নতুন লেখা যোগ করল, পেন্সিল দিয়ে—

“আজ প্রথমবার, আমি ওর চোখে সত্যি একজন আপন মানুষকে দেখেছি।
ওর ডায়েরিটা যেন আমার ‘নিজেকে ফিরে পাওয়ার আয়না’।
হয়তো, আমি এতদিন ওকে ভুল বুঝেছি।
হয়তো আমি ভালোবেসে ফেলেছি ওর খামখেয়ালিপনাকে।”


পরদিন স্কুলে আসতেই একটা গুঞ্জন—

“রুদ্র-মেহরিন প্রেম করছে!”
“ডায়েরি দিয়ে প্রেম প্রপোজাল!”
“মেহরিন নাকি এখন রুদ্রের সঙ্গে টিফিন করে!”

মেহরিন চুপচাপ সোজা চলে যায় ক্লাসে। কিন্তু সহ্য করতে পারে না যখন দু-তিন জন মেয়ে এসে বলে,
— “তুইও না! এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়লি?”
— “ও তো একটা উড়নচণ্ডী... তোর মতো মেয়ে ওর সঙ্গে যায়?”

রুদ্র জানে এইসব কথা কেমন কষ্ট দেয়। সে চুপচাপ এসে মেহরিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে—

— “তুই চাইলে আমি পুরো স্কুলকে বলব, আমরা শুধু বন্ধু।”
— “তুই চাইলে আমি স্কুলটাই ছেড়ে দেব।”
— “কিন্তু আমি চাই, তুই যা বলবি, সেটা মন থেকে বলিস। ভয় পেয়ে না।”

মেহরিন এবার প্রথমবার তার দিকে তাকিয়ে বলে—

— “আমি কিছুই লুকাব না।
আমার বন্ধুত্ব তোকে দিয়েছে হৃদয়ের স্পর্শ।
আর যদি কিছু শুরু হয়, সেটা সবাই দেখুক,
কারণ তুই আমার খামখেয়ালি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সত্যি।”

রুদ্র চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ,
তারপর বলল—
— “তোর কথায় মন ভালো হয়ে যায় রে, বোরিং মেয়ে।”
— “আমি বোরিং? তাহলে তুই তো পুরো নাটক।”
— “তুই আমার গল্পের প্রথম পাতায় লেখা নাম।”


Sunday, June 15, 2025

নীলপরী নীলাঞ্জনা

গল্পের ভান্ডার ;





             নীলপরী নীলাঞ্জনা




নীলপরী নীলাঞ্জনা 💙

সুনীল পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটি গ্রাম – শান্তিপুর। সবুজ বন, ঝিরিঝিরি পাহাড়ি ঝরনা, আর দূরের নীলাকাশ যেন এখানে এসে থেমে গেছে। এখানে সময় চলে ধীরে ধীরে। গ্রীষ্মের বিকেলগুলো হয় একদম স্বপ্নের মতো — বাতাসে লেবুগাছের গন্ধ, দূরে বাঁশবাগানের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কাঠের পুরনো বাড়ি।

এই গ্রামের পাশেই এক অদ্ভুত নিরিবিলি জায়গা, নাম নীলপরীর গুহা। গ্রামের লোকেরা বলে, সেখানে কখনো কখনো এক মেয়েকে দেখা যায় — মাথাভরা চুল, নীল শাড়ি, আর চোখে গভীর নদীর মতো দৃষ্টি। কেউ বলে সে মানুষ নয়, পরী। কেউ বলে, সে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়।

নাম তার নীলাঞ্জনা
বয়স বেশি না — একুশ কি বাইশ হবে।
নাম শুনলেই কেমন একটা নীল ছায়া এসে ঘিরে ধরে হৃদয়কে।



অভি, ঢাকা শহরের এক তরুণ চিত্রশিল্পী, জীবনের কোলাহলে হাঁপিয়ে গিয়ে একদিন চলে আসে এই গ্রামে — ছবি আঁকার জন্য, নিজের ভেতরটা খুঁজে পাওয়ার আশায়।

একদিন বিকেলে সে চলে যায় পাহাড়ের পাশে, এক নিঃসঙ্গ গাছের নিচে বসে ছবি আঁকছিল। হঠাৎই ঝরনার নিচে একটা ছায়া দেখতে পেল — নীল শাড়ি পরা এক মেয়ে, এক হাতে জলে ছুঁয়ে কিছু অনুভব করছে।

অভির চোখ আটকে যায়।
তার মনে হয়, এই মেয়েকে সে আগে কোথাও দেখেছে — হয়তো কোনো স্বপ্নে, হয়তো কোনো পুরনো ক্যানভাসে।

সে হঠাৎ করে বলে ওঠে,
— "তুমি কি... মানুষ? নাকি পরী?"

মেয়েটি ঘুরে তাকায়, চোখে হালকা হাসি —
— "তুমি মানুষ বলেই প্রশ্ন করলে, নইলে বুঝে নিতে পারতে।"

তারপর মেয়ে হেঁটে চলে যায়... আর অভি বসে থাকে, একরাশ বিস্ময়ে।



পরদিন অভি গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে মেয়েটির কথা।
সবাই বলে,
— "ওহে বাবু, তুমি নিশ্চয়ই নীলপরী নীলাঞ্জনাকে দেখেছো। ওর কথা কেউ বলে না, শুনলে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়।"

কিন্তু কেন? কী এমন আছে মেয়েটির গল্পে?

কেউ জবাব দেয় না।

অভি ঠিক করে, সে খুঁজে বের করবে নীলাঞ্জনার সব রহস্য।
কে এই মেয়ে? কেন তার চোখে অতটা বিষাদ?
এবং কেনই বা সে মনে হয়, যেন তাকে অভি চেনে বহুদিন ধরে?




সন্ধ্যার রোদ পড়ে এসেছে। পাহাড়ে হালকা কুয়াশা নেমে এসেছে, আর গ্রামের বাতি একে একে জ্বলে উঠছে। অভি বসে আছে নিজের লজের বারান্দায়, হাতে স্কেচবুক — কিন্তু আজ তার তুলির কোনো আঁচড় নেই।

তার চোখের সামনে শুধু সেই মেয়েটি — নীল শাড়ির মতো স্নিগ্ধ, আর চোখে গভীর কিছু হারানোর হাহাকার।

তার নাম কি সত্যিই নীলাঞ্জনা?
না কি সে শুধু গ্রামের গল্প হয়ে বেঁচে থাকা এক নিঃসঙ্গ আত্মা?



পরদিন সকালে অভি গ্রামের পুরনো লাইব্রেরির দিকে হাঁটছিল। হঠাৎ দেখলো একজন বুড়ো লোক, মাটির পিঁড়িতে বসে চা খাচ্ছে। গায়ের চাদর, হাতে বাঁশের লাঠি — চোখে অদ্ভুত এক বোধি-শান্তি।

অভি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “চাচা, আপনি কি নীলপরী নীলাঞ্জনাকে চেনেন?”

বুড়ো লোকটি হাসলো হালকা করে।
— “তুই কি ওকে দেখছিস?”
— “হ্যাঁ… ঝরনার পাশে। কথা বলেছি… হয়তো স্বপ্নে?”

বুড়ো লোকটি গভীর শ্বাস নিলো।
— “নীলাঞ্জনা... ও ছিল সবার স্বপ্নের মেয়ে। শহর থেকে এখানে এসেছিল বছর পাঁচেক আগে। চুল ছেঁড়া বাতাসে উড়তো, আর গলায় ছিল গজলের মত সুর। সবাই বলতো, মেয়েটার চোখে নদীর মত বিষাদ আছে।”

— “তারপর?” অভির গলা শুকিয়ে আসে।

— “তারপর একদিন, ও হারিয়ে গেলো। কেউ বললো আত্মহত্যা করেছে, কেউ বললো ও পাহাড় ডেকে নিয়েছে। কেউ আবার বললো— ও পরী হয়ে গেছে... কারণ এখনো ঝরনার ধারে দেখা যায়, এক নীল শাড়ি পরা মেয়েকে। তবে কেউ কাছে গেলে, সে মিলিয়ে যায়।”

অভির শরীরের রোম কাঁপতে লাগল।

সে তো সেই মেয়েকেই দেখেছে! তবে কি সে... মৃত?



রাতে ঘুম আসছিল না অভির। জানালার বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ দেখতে পেল এক ছায়া —
একটা নীল শাড়ি, ধীরে ধীরে রাস্তা পার হচ্ছে... তার দিকেই তাকিয়ে।

অভি তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেল। কিন্তু বাইরে গিয়ে দেখল, কেউ নেই।
তবে বাতাসে ভেসে আসছে এক টুকরো গানের সুর —
একটা পুরনো রবীন্দ্রসংগীত...
"কে তুমি, নীলে ঢাকা..."

সে গলা সেই মেয়েটির!
সে জানে — সে সত্যিই ছিল, এখনো আছে।



পরদিন অভি স্কেচবুকে একটি ছবি আঁকে —
একটা ঝরনা, পাশে দাঁড়িয়ে এক নীল শাড়ি পরা মেয়ে, যার চোখে লুকিয়ে অসীম গভীরতা।

ছবির নিচে লেখে সে,
“আমি তোমায় খুঁজে পাবো, নীলাঞ্জনা। তুমি যদি স্বপ্ন হও, তাও তোমায় জাগরণে খুঁজবো।”




এক সপ্তাহ কেটে গেছে।
অভি এখন আর শুধু পাহাড়ের ছবি আঁকে না। প্রতিদিন সকালে সে বেরিয়ে পড়ে — ঝরনার ধারে, গুহার পথে, পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে। নীলাঞ্জনার দেখা সে আর পায় না, কিন্তু কোথাও একটা সে জানে — মেয়েটি তাকে দেখছে।



এক সকালে অভি পুরনো একটি বাঁশবনের পথ ধরে হাঁটছিল। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা কাঠের ভাঙা কুঁড়েঘর। কৌতূহলবশত সে ভেতরে ঢোকে। ধুলো জমা বই, ছেঁড়া কাগজ, ভাঙা আয়না — সব কিছুতেই জমে আছে ফেলে আসা কোনো এক জীবনের নিঃশব্দ চিহ্ন।

হঠাৎ একটা পুরনো খামে ভরা চিঠি পায় সে —
নীলচে রঙের পাতায় হস্তলিখিত কয়েকটি লাইন:

“আমার চোখের নীল দেখে অনেকে ভালোবেসেছে, কিন্তু কেউই আমার বিষণ্নতা বোঝেনি।
যার চোখে একদিন নিজেকে খুঁজেছিলাম, সে-ই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভুল বুঝেছিল।
আমি পালিয়ে যাচ্ছি, নিজেকে ফিরে পেতে। যদি কোনোদিন কারো ভালোবাসা সত্যি হয়ে আসে—
সে আমাকে খুঁজে নেবে এই পাহাড়েই।”

নীলাঞ্জনা

চিঠির লেখা দেখে অভির বুক কেঁপে উঠে।
সে বুঝে যায় — মেয়েটি পালিয়ে গিয়েছিল, মরেনি। আর তার অপেক্ষা এখনো শেষ হয়নি।



সন্ধ্যায়, যখন অভি কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে ফিরছিল, হঠাৎ ঝরঝরে বৃষ্টি নামে। এক পাহাড়ি মোড় ঘুরতেই একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
গাড়ি থেকে নামেন এক তরুণ — শার্ট-প্যান্ট পরা, চোখে সানগ্লাস। অভির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
— “আপনি কি এখানে নতুন এসেছেন?”

— “হ্যাঁ,” অভি উত্তর দিল।
— “আমি তাসিন। আগে এখানে থাকতাম... অনেক বছর পর ফিরলাম। একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছি। তার নাম ছিল নীলাঞ্জনা।”

অভি থমকে যায়।

এই নাম তার মুখে শুনে অভির বুক কেমন ধক করে ওঠে।
তাসিন বলল,
— “সে আমার বাগদত্তা ছিল… কিন্তু হঠাৎ করে হারিয়ে গেল। এখনো খুঁজে ফিরি ওকে।”

অভি কিছু বলতে পারল না।
নীলাঞ্জনা যদি তাসিনের হয়ে থাকে, তবে তার প্রতি অভির এই টান কী?

রাতে অভি বারান্দায় বসে, বৃষ্টির শব্দ শুনছিল।
সে ভাবছিল —

"তাসিন কি সত্যিই ভালোবাসে নীলাঞ্জনাকে?
তবে সে কেন তাকে ভুল বুঝেছিল?
আর কেন আজও মেয়েটি তার কাছে ফেরেনি?"

অভি জানে, তার হৃদয়ে আজ এক নীল নদী বয়ে চলছে।
এক মেয়েকে সে না জেনেও ভালোবেসে ফেলেছে।
আর সেই ভালোবাসা যেন প্রতি রাতে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
— “তুমি ওর খোঁজে এসেছো… এখন ও তোমার মধ্যেই খুঁজছে মুক্তি।”












রাত গভীর। অভির মন যেন অশান্ত এক সাগর। বারবার চোখ খুলে সে চেয়ে থাকে জানালার বাইরে, যেখানে রাতের নীরবতা মাঝে মাঝে নীল আলোয় ভেসে ওঠে।

সকাল বেলায় সে আবার পুরনো কুঁড়েঘরটিতে যায়। সেখানে সে পায় একটা ভাঙা ট্রাঙ্ক, আর ভেতর থেকে বের হয় এক পুরনো দিনলিপি। পাতা উল্টিয়ে পড়তে থাকে:

“২৫শে বৈশাখ: আজ তাসিন আমার গলায় বলেছে ভালোবাসে। আমি হাসি দিয়ে বলেছিলাম, ভালোবাসা শুধু কথা নয়, প্রমাণ চাই...
৩০শে জ্যৈষ্ঠ: ওর চোখ আজ অন্য কারো জন্য ছিল, আমি চুপ করে শুনলাম।
১২ই আষাঢ়: সিদ্ধান্ত নিয়েছি পালাবো, ভালোবাসা যদি বুঝতে না পারে, আমি আমার নীরবতাই বাঁচবো।”

অভির মন ভারাক্রান্ত হয়। বুঝতে পারে তাসিন ও নীলাঞ্জনার মধ্যে মধুর কিছু ছিল, কিন্তু বোঝাপড়া হয়নি।

বিকেলে ঝরনা ঘাটে ফিরে অভি দেখে নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে আছে, চোখে এক ধরনের বিষন্নতা। সে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কেন পালিয়ে গেছ?”
নীলাঞ্জনা চুপ করে থাকে, শেষে বলে,
“সবাই আমার রঙ ভালোবাসে, কিন্তু আমাকে নয়... তুমি পারবে আমাকে যেমন আমি, তেমন করে ভালোবাসতে?”
অভি বলে, “আমি তোমার চোখের ভিতরের নদী ভালোবাসি।”

নীলাঞ্জনার চোখ ভিজে ওঠে, কিন্তু সে কোনো উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ের দিকে হারিয়ে যায়।

সেই রাতে অভি ডায়েরিতে লিখে,
“ওর হৃদয়ের দরজা বন্ধ, তবুও আমি অপেক্ষা করব, কারণ আমি শুধু পরী নই, ওর মানুষটাকেই ভালোবেসেছি।”



অভির মনে তাসিনের কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। কি করে সে এসে নীলাঞ্জনার জীবনে এমন প্রভাব ফেলেছে?
তাসিন কি সত্যিই শুধু এক বাগদত্তা, নাকি এর পিছনে কিছু গোপন সত্য আছে?

এক বিকেলে, অভি ঠিক করে তাসিনের সাথে দেখা করবে।
ঝরনার ধারে দেখা হল দুই পুরুষের। এক জন ছিল অভি, আর অপরজন তাসিন।

তাসিন বলল,
“আমি নীলাঞ্জনাকে খুব ভালোবেসেছি, কিন্তু সে অন্য এক জগতের মেয়ে। সে শান্তিতে থাকতে চায়, আর আমি শহরের চাপে তাকে ধরে রাখতে পারিনি।”

অভি সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করল,
“তুমি কি কখনো ভেবেছো, ওর পিছু নেওয়া তোমার ভালোবাসা না ওর স্বাধীনতার মধ্যে বঞ্চনা?”

তাসিন খানিক থেমে বলল,
“হয়তো। আমি চাইনি সে হারিয়ে যাক, কিন্তু হয়তো আমি ওর পিছু ছাড়িনি।”

অভির হৃদয় নীরব, সে বুঝতে পারল ভালোবাসার সঙ্গে ক্ষমতাও যেন মিশে থাকে।
নীলাঞ্জনার জন্য একটা মুক্তির দরজা খোলার দায়িত্ব এখন তার।



অভি বাড়িতে ফিরে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল।
তাসিনের মুখোমুখি কথা তাকে এক নতুন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু আসল গল্প জানার জন্য সে একমাত্র পথ — নীলাঞ্জনার কাছে যাওয়াই।

পরদিন সন্ধ্যায় অভি আবার সেই পাহাড়ি ঝরনার ধারে পৌঁছালো।
নীলাঞ্জনা জলের ধারে বসে ছিল, চোখে মেঘলা ছায়া।
অভি চুপচাপ বসে গেল পাশে।

নীলাঞ্জনার প্রথম কথা ছিল,
“তোমার কাছে আসাটা আমার জন্য সহজ ছিল না। অনেক দিন ধরে আমি নিজেকে হারিয়ে রেখেছিলাম।”

তার চোখে জলের মত মায়া ভাসছিল।
“আমি কখনো চাইনি আমার চোখের নীল রঙটা কেউ শুধুমাত্র সুন্দর বলে দেখুক। আমার নিজের ভেতরের যন্ত্রণাও তো কেউ বুঝুক।”

নীলাঞ্জনা ধীরে ধীরে বলল,
“তাসিন ভালোবাসতো আমাকে, কিন্তু সে চায় সবকিছু নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে। সে বুঝতে পারেনি আমি স্বাধীন থাকতে চাই। আমি বাঁধা দিতে পারিনি  তাই পালিয়ে এসেছি।”

অভি বলল,
“আমি কখনো তোমার রঙের জন্য নয়, তোমার নিঃশব্দ কান্নার জন্য ভালোবেসেছি।”

নীলাঞ্জনা প্রথমবার একটুও লাজ বা দ্বিধা ছাড়াই বলল,
“আমার অনেক ভয় আছে, অভি।
ভয় যে কেউ আমাকে বুঝবে না, ভয় যে কেউ আমার পাশে থাকবে না।”

অভি তার হাতটা ধীরে ধরে ধরে বলল,
“আমি থাকব, যত দিন তোমার ভয় থাকবে।”



নীলাঞ্জনা বলল,
“আমার ছোটবেলায় আমি এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম।
তারপর থেকে আমি অনেকদিন একাকী থাকতাম, কারও চোখে আসতে ভয় পেতাম। আমার পরিবার আমাকে ঠিক মতো বুঝতেও পারেনি। আর তারপর তাসিন আমার জীবনে এলো, তার ভালোবাসা ছিল সত্যি, কিন্তু সে আমার গভীর আঘাতগুলো দেখেনি।”

অভি গভীর ভাবে শুনল, তার মনে হলো যেন নীলাঞ্জনার আঘাতগুলো তার নিজের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে।
সে বুঝল, এই মেয়েটা শুধু রঙিন চোখের মায়াবী নয়, এক জীবনের বেদনার গল্প।

সেদিন অভি আর নীলাঞ্জনা নদীর তীরে বসে রাতের তারাগুলো গুনছিল।
তারা জানতো, সামনে অনেক পথ আসবে, কিন্তু একে অপরের হাতে হাত রেখে তারা সেই পথ হাঁটবে।

অভি বলল,
“তুমি আমার নীল নদীর সেই নীল পরী, যে দুঃখ-সুখের নদী পেরিয়ে এলো। আমি তোমার সঙ্গে আছি, আজীবন।”

নীলাঞ্জনার হাসি যেন প্রথমবারের মতো সত্যি মনের থেকে বের হলো।
তার চোখে ঝলমল করলো এক নতুন আশা।













নীলাঞ্জনার মুখে প্রথমবারের মতো একটা খুশির ঝিলিক স্পষ্ট।
কিন্তু অভির মনে একটা অজানা টানাপোড়েন কাজ করছিল। তাসিনের কথা বার বার ফিরে আসছিল।
সে জানত, তাসিনের হারানো ঠিক নয়, ওর ফিরে আসারও সম্ভাবনা আছে।

এক বিকেলে, ঝরনার ধারে তারা দুজনে বসে আকাশের রঙের খেলায় মগ্ন ছিল, হঠাৎ ফোনে একটা অজানা নাম তার সামনে এল — তাসিন।
অভি সজাগ হয়ে উঠল, আর নীলাঞ্জনা কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ল।



তাসিন বলল,
“আমি বুঝতে পারছি আমার ভুল ছিল, আমি ফিরে এসেছি… নীলাঞ্জনা, আমাকে আবার শোনো।”

নীলাঞ্জনা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল, ওর মনে একটা জটিলতার সৃষ্টি হলো।
অভি চুপ থেকে শুধু তাকে ধীরে ধীরে দেখছিল।



অভির মনে হচ্ছিল, সে নীলাঞ্জনার জন্য যতোটা ভালো চায়, তার চাইতেও বেশি প্রয়োজন নীলাঞ্জনার মানসিক শান্তি।
সে বুঝতে পারল, তাকে নিজেকে পেছনে সরিয়ে নিতে হবে, যেন নীলাঞ্জনা নিজের মতো করে ঠিকমতো জীবন গড়তে পারে।

অভি একান্তভাবে নীলাঞ্জনার কাছে গেল এবং বলল,
“আমি তোমার জীবনে শান্তির বাতাস আনার চেষ্টা করবো, কিন্তু যদি কখনো তুমি নিজেকে হারিয়ে যাও, আমি থাকবো তোমার পাশে।”



নীলাঞ্জনার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু এবার তা বিষাদের নয়, মুক্তির।
সে বলল,
“আমি জানি, আমি এখনও ভীত, কিন্তু তোমার মতো কেউ আমার পাশে থাকলে আমি সাহস পাই।”

দুজনের মধ্যকার বন্ধন আরও গভীর হলো।
তারা জানতো, প্রেম মানেই শুধু সুখ নয়, কষ্টেরও এক অধ্যায় থাকতে হয়।





দিনগুলি ক্রমে ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল।
অভি আর নীলাঞ্জনা মেলামেশা বাড়ালেও তাসিনের ফেরার খবর তাদের মনে একটা অচেনা চাপ তৈরি করেছিল।

এক বিকেলে অভি জানতে পারে, তাসিন আসলে নীলাঞ্জনার জীবনে শুধু প্রেমিক ছিল না, তার পেছনে একটা বড় রং বেরঙের ব্যবসার অংশীদার ছিল।
নীলাঞ্জনার ওপর তার আগ্রহ শুধু ভালোবাসা ছিল না, বরং এক ধরনের ক্ষমতার ছায়া।



নীলাঞ্জনা তাসিনের সঙ্গে কথা বলল যখন সে এল।
“তুমি কেন এসেছো?”
তাসিন মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলল, “আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনি, তবে শুধু ভালোবাসার জন্য না, একটা বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে।”

নীলাঞ্জনা বুঝতে পারল, তাসিনের কথার পেছনে একটা বড় অন্ধকার লুকিয়ে আছে।
সে ভয় পেল, অভির জন্যও ঝুঁকি হতে পারে।



অভি নির্ধারিত করে নীলাঞ্জনাকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হতে।
তাদের মধ্যে একটি অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করতে লাগল — যেখানে ভালোবাসার সঙ্গে নিরাপত্তার লড়াই শুরু হল।




নীলাঞ্জনা একদিন случайত পুরনো একটা চিঠি পায়, যা তার বাবার থেকে আসা।
চিঠিতে লেখা ছিল তার পরিবারের গোপন কাহিনী, যেখানে উঠে আসে তাসিনের আসল সম্পর্ক, শুধু প্রেমিক নয়, বরং একটা বড় সখ্য।



নীলাঞ্জনা বুঝতে পারে, তার পরিবারের সাথে তাসিনের সম্পর্ক অনেক জটিল।
তাসিনের পেছনে আছে আরেক গোপন সত্তা, যা তার জীবনের অনেক অন্ধকার কথা খুলে দিতে পারে।



অভি যখন এই গোপন সত্য জানে, তখন তার মনে হয় নীলাঞ্জনার পাশে থাকা আরো কঠিন হয়ে উঠবে।
সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই গোপন রহস্য সামনে নিয়ে এসে সব কিছু স্পষ্ট করতে হবে।



নীলাঞ্জনা আর অভি একসাথে বসে ঠিক করল, তারা এই গোপন সত্যের মুখোমুখি হবে।
তাদের সম্পর্কের পরিক্ষা এখন শুরু, যেখানে বিশ্বাস আর ভালোবাসার নতুন অধ্যায় লেখা হবে।




নীলাঞ্জনা আর অভি মিলে গোপন চিঠির সূত্র ধরে তাসিনের অতীত জানার চেষ্টা করল।
তারা জানল তাসিন শুধু ভালোবাসার জন্য নয়, ব্যবসায়িক এক সংঘবদ্ধ দলের সঙ্গে যুক্ত, যারা নীলাঞ্জনার পরিবারের সম্পত্তি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।



নীলাঞ্জনা নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে চায়, কিন্তু তাসিনের বিশ্বাসঘাতকতা তার মন ভেঙে দিয়েছে।
অভি সাহস যোগায় বলল,
“আমরা একসাথে থাকব, সব বাধা পেরিয়ে।”



নীলাঞ্জনা তার নিজের শক্তি খুঁজে বের করল।
সে ঘোষণা করল,
“আমি আর কোনো ছায়ার মধ্যে বাঁচব না। নিজের মতো করে জীবন কাটাব।”



অভি ও নীলাঞ্জনা একসাথে জীবন গড়ার সিদ্ধান্ত নিল।
তারা বুঝল, ভালোবাসা মানে শুধু সুখ নয়, সংগ্রাম আর বিশ্বাসও।












নীলাঞ্জনা আর অভি মিলে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করল।
তারা নিজের জীবনের পুরনো ব্যাথা আর শঙ্কা পেছনে ফেলে সামনে এগোতে চাইল।

অভি সবসময় নীলাঞ্জনার পাশে দাঁড়াল,
“তুমি একা নও, আমি আছি।”
নীলাঞ্জনার চোখে আবার ফিরে এল আত্মবিশ্বাসের আলো।
সে শপথ করল, আর কেউ তাকে ভেঙে ফেলতে পারবে না।

তাসিন বুঝতে পারল, নীলাঞ্জনা তার থেকে দূরে সরে গেছে।
সে এবার তার পরিকল্পনা শক্ত করার জন্য নতুন কৌশল নিয়েছে, যা নীলাঞ্জনা ও অভির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।



যদিও জীবন কঠিন, ভালোবাসার শক্তি সব বাধা পার হতে পারে।
নীলাঞ্জনা ও অভি সেটাই প্রমাণ করতে চায়।



নীলাঞ্জনা আর অভির শান্তি কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল।
তাসিনের নতুন কৌশল শুরু হলো, যা ছিল নিঃসন্দেহে তাদের জীবনে নতুন ঝুঁকি নিয়ে আসার ইঙ্গিত।


তাসিন তার সহযোগীদের মাধ্যমে নীলাঞ্জনা ও অভির গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে লাগল।

তার উদ্দেশ্য ছিল তাদের দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করে খেলা চালানো।

অভি নীলাঞ্জনাকে সতর্ক করল,
“তাসিন ছাড় দেবে না, আমাদের একসাথে থাকতে হবে, প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।”

নীলাঞ্জনা এবার ভয় পায়নি,
“আমার নীল চোখ শুধু রং নয়, এতে শক্তি আছে। আমি লড়াই করব, যত দিন আমার পাশে তুমি আছো।












নীলাঞ্জনা আর অভি এখন পুরোপুরি একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল।
তাদের মধ্যে বিশ্বাস আর ভালোবাসার শক্তি ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
তাসিনের ষড়যন্ত্র যতই বড় হোক, তারা মিলেমিশে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।



অভি তার টেকনিক্যাল দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তাসিনের চালাকি ফাঁস করতে শুরু করল।
নীলাঞ্জনা তার আত্মবিশ্বাস ও সাহস দিয়ে নতুন পথে এগিয়ে গেল।



নীলাঞ্জনা বুঝতে পারল, নিজের শক্তি ও সঠিক সাহসের মাধ্যমে সে জীবনের সকল বাধা পার করতে পারে।
অভি ও নীলাঞ্জনার বন্ধন আরও মজবুত হল।



নীলাঞ্জনা আর অভি যখন নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে নিচ্ছিল, তখন তাসিনের চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
তাসিন এবার এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা তাদের জীবন পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে।



নীলাঞ্জনা ও অভি একসঙ্গে লড়ে গেল।
তাদের ভালোবাসা ছিল যেন এক মজবুত প্রাচীর, যা ভাঙতে পারে না কোনো ষড়যন্ত্র।

বিপদের মাঝেও তারা তাদের স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখল।
নীলাঞ্জনার চোখে আবার জ্বলে উঠল নতুন দিনের আলো।



নীলাঞ্জনা আর অভি সব প্রতিকূলতা জয় করে আজ সেই স্বপ্নীল সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে।
সূর্য ডোবার আলোতে যেন রক্তিম রঙ ছড়িয়ে পড়ছিল, ঠিক যেন তাদের হৃদয়ের স্পন্দন।



অভি ধীরে ধীরে নীলাঞ্জনার হাতটা ধরে বলল,
“তুমি আমার জীবনের আলো, আমার নীল আকাশের নীলপরী। তোমার ভালোবাসা ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”

নীলাঞ্জনার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু সেটা ছিল আনন্দের, প্রেমের।
সে বলে উঠল, “অভি, তোমার হাতে হাত রেখে আমি নতুন জীবন শুরু করতে চাই, যেখানে শুধু তোমার সঙ্গে থাকব।”



সন্ধ্যার হাওয়ায়, তারা একে অপরের গালে মৃদু চুম্বন দিল।
মুহূর্তটা যেন থমকে গিয়েছিল, সময় যেন নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে।

অভি ফিসফিস করে বলল,
“তুই আমার নীলপরী, চিরদিন আমার সঙ্গে থাকবে, এই পৃথিবীর সব সুখ-দুঃখে।”



নীলাঞ্জনার হৃদয় ভরে উঠল প্রেমে, সে অনুভব করল জীবনের সব অন্ধকার মুছে গেছে,
শুধু অবিরাম ভালোবাসার আলোই আজ তার পাশে জ্বলছে।



তারা দুজন জীবনের নতুন পথে হাঁটতে শুরু করল, হাতে হাত রেখে, হৃদয় হৃদয় মিলিয়ে,
একসাথে গড়বে এক নতুন সুন্দর সকাল — যেখানে শুধু থাকবে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আশা।






Friday, June 13, 2025

🌒 "অন্তরালে রহস্য"

গল্পের শহর ;

  



     🌒 "অন্তরালে রহস্য"


         

 

             🖋️ পর্ব ১:

ঢাকার এক বর্ষাস্নাত সন্ধ্যা।

সুনয়না সরকার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। পানির ফোঁটা কাঁচে পড়ে ঝাপসা তৈরি করছিল, আর তার মনেও যেন একরাশ ঝাপসা আবেগ। একঘেয়ে কর্পোরেট জীবন, বিয়ে নিয়ে বাড়ির চাপ, বন্ধুত্বের নামে ফাঁপা সম্পর্ক—সব মিলিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠেছে।

রাত আটটা পেরিয়ে গেছে। বাসায় একা সে। এমনি একটা সময়ে কলিং বেল বেজে উঠল।

সে চমকে উঠল।
— “এত রাতে কে এল?”

দরজা খুলতেই এক ভিজে যুবক। গায়ে হালকা বাদামি জ্যাকেট, হাতে ছেঁড়া একটা খাম। চোখে একরাশ অস্থিরতা।

— “আপনি সুনয়না সরকার?”
— “জি, আমি... আপনি কে?”
— “আমার নাম অয়ন। আমি আপনার জন্য রিশানের কাছ থেকে চিঠি এনেছি।”

রিশান!
এই নামটা শুনেই তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল।
তিন বছর আগে যে মানুষটা তাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত, এক সকালে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। পুলিশ বলেছিল এক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। অথচ... আজ?

সে হাতে চিঠিটা নিল। ছেঁড়া খামের ভিতরে সাদা কাগজে স্পষ্ট রিশানের হাতের লেখা।

“সুনয়না,
আমি বেঁচে আছি। তুমি যা জানো, তার এক শতাংশও সত্যি নয়। আমার নিখোঁজ হওয়া দুর্ঘটনা ছিল না—এটা ছিল সাজানো নাটক।
আমি এমন কিছু জানতাম যা কাউকে জানানো ঠিক ছিল না। এখন ওরা আমার পেছনে, আর তোমারও।
অয়নের উপর ভরসা করো। তার সাথেই পালিয়ে যাও—এই শহর ছেড়ে।

—রিশান”

সুনয়নার গলা শুকিয়ে গেল।
সে চিঠির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি কীভাবে রিশানকে চেনো?”
অয়ন কেবল বলল,
— “ও আমার বড় ভাইয়ের মতো। আমরা একসাথে একটা গোপন প্রজেক্টে কাজ করতাম। তারপর... সে নিখোঁজ হয়ে যায়। এখন ও চাইছে আপনি নিরাপদ থাকুন।”

সুনয়না হঠাৎ লক্ষ্য করল—অয়নের কাঁধে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। রক্ত ঝরছে।

— “তোমার কাঁধে রক্ত... কী হয়েছে?”
— “তারা আমাকে অনুসরণ করেছে। খুব বেশি সময় নেই। আমাদের এখনই যেতে হবে।”

হঠাৎ বাইরের রাস্তা দিয়ে একটা কালো ভ্যান গর্জন করে চলে গেল। অয়ন জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “ওরা এখানে পৌঁছে গেছে।”

সুনয়না বুঝতে পারল—এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত না নিলে জীবন বদলে যাবে।
সে যাবে কি না—এখনও জানে না।
কিন্তু একটা জিনিস সে বুঝে গেছে—জীবনের ছন্দটা আর আগের মতো নেই।

Wednesday, June 11, 2025

গল্প: কাছের মানুষ

গল্পের ভান্ডার 📖




গল্প: কাছের মানুষ





পর্ব – ১: ছাদে বসন্তের আলো

ছাদে বসন্তের বিকেল নেমেছে একদম নিঃশব্দে।
সন্ধ্যার আলোর পূর্বছায়ায় লালচে সোনালি একটা রঙ মিশে গেছে চারপাশে। বাতাসে শিমুল ফুলের গন্ধ—শুধু গন্ধই না, কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা, একটা পুরনো দিনের হাতছানি।

ইস্রা ধীরে ধীরে ছাদে ওঠে। খুলনার এই পুরনো ফুপু বাড়িটার প্রতি একটা অদ্ভুত মায়া আছে ওর। চুন খসে পড়া দেওয়াল, সবুজ শ্যাওলা ধরা কর্নার, ছাদে ঝুলে থাকা পুরনো টেলিভিশনের অ্যান্টেনা—সব মিলিয়ে একটা অলিখিত ইতিহাস যেন এখানে আটকে আছে। এখানে সময়টা একটু ধীর চলে, মানুষের মুখে শব্দ কম কিন্তু চোখে অনেক কিছু লেখা থাকে।

এমন সময় হঠাৎ একটা গলা কানে আসে—
"ইস্রা?"

একটা ধাক্কা খায় ওর ভিতরের মন। এই গলার টানটা, উচ্চারণের ঢঙ, মৃদু হাসির ভঙ্গি—সবকিছু এতটা পরিচিত যে হঠাৎ বুকটা ধক করে ওঠে।

ও ঘুরে দাঁড়ায়।
সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তৌহিদ ভাইয়া।


তৌহিদ—ওর ফুপাতো ভাই। পাঁচ বছরের বড়। ছোটবেলা থেকে যাকে নিয়ে ওর দুনিয়ার অনেক গল্প, অনেক আনন্দ, আবার অনেক না বলা অনুভবও গাঁথা হয়ে আছে।

তৌহিদ ভাইয়া তখন মেডিকেলে পড়ত, আর ইস্রা তখন মাত্র স্কুলে। কিন্তু ভাইয়ার সাথে সম্পর্কটা ছিল অন্যরকম। খেলনা গাড়ি থেকে শুরু করে, ক্লাসের হোমওয়ার্ক, ঈদের জামা, এমনকি প্রথম দুষ্টুমিতে বকা খাওয়ার স্মৃতিও—সবটাই তৌহিদের ছায়ায় রঙিন হয়ে থাকতো।

– "তুই কিছু বলছিস না?"
তৌহিদের গলায় কেমন যেন পুরনো একটা অভিমান লুকানো।

ইস্রা একটু হেসে বলে,
– "বলবো কী! এত বছর পর এমন করে সামনে দাঁড়িয়ে যাবি, তা ভাবিনি তো।"
– "হুম... সাত বছর তো কম সময় না। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো, তুই ঠিক সেই আগের ইস্রা। চোখ দুটো একটু বড় হয়ে গেছে, চুলগুলো একটু বেশিই এলোমেলো, তবে হাসিটা—ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে।"

ইস্রা চুপ করে যায়। বুকের ভেতর কেমন অস্বস্তি, আবার কেমন যেন আলোড়ন।
তৌহিদের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মাথার চুলে খানিক পাক ধরা, মুখে একটা গাম্ভীর্য, কিন্তু চাহনিটা... ঠিক আগের মতোই। যেন ওর মুখের প্রতিটি অনুভব পড়ে নিতে পারে সহজেই।

– "তুই এখনও ঢাকায়?"
– "হ্যাঁ, ঢাকা মেডিকেলে পড়াই এখন। তোর খবর শুনি মাঝেমধ্যে।"

তারা দুজন ছাদের উত্তর-পশ্চিম কোনায় গিয়ে বসে। নিচে লিচু গাছের মাথা দুলছে বাতাসে। দূর থেকে আজানের ধ্বনি আসছে।

– "তুই জানিস?"
– "কী?"
– "তোকে মিস করতাম, রীতিমতো। এমনকি তোকে নিয়ে একটা ডায়েরিও লিখতাম। ফুপি বলত, ভাই-বোনের মাঝে দূরত্ব রাখা ভালো। আমি ভাবতাম, কেন? তোকে তো আমি ভাইবোনের চেয়ে অনেক বেশি কিছু ভাবতাম..."

ইস্রার চোখে জল এসে যায়। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
কোনোদিন বলার সাহস হয়নি—তৌহিদ ভাইয়ার প্রতি নিজের অনুভবের কথা। কোনোদিন বলতে পারেনি যে যখন বন্ধুদের প্রেম নিয়ে কথা বলতো, তখন ওর মনের কোন এক কোণে শুধুই তৌহিদের মুখ ভেসে উঠতো।

ভালোবাসা শব্দটা উচ্চারণ করার মতো সাহস তো দূরের কথা, সেই সম্পর্কটার নামও জানতো না ইস্রা।

কিন্তু আজ... এত বছর পর... সেই ছাদে, সেই পুরনো শহরের বাতাসে, সেই মুখটা আবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে—সব অতীত যেন চোখের সামনে সিনেমার মতো ঘুরছে।


তৌহিদ হঠাৎ একটা কথা বলে,
– "ইস্রা, আমরা কী পারি না? নতুন করে শুরু করতে?"

ইস্রা চমকে তাকায়।
– "কী শুরু?"
– "এই সম্পর্কটা, যেটা ছোটবেলায় ছিল। এখন একটু অন্যভাবে, একটু পরিণতভাবে। আমি জানি, মানুষ সমাজ দেখে। কিন্তু তুই আমার আপনজন ছিলি, আর এখনও আছিস। তুই চাইলে আমি—"

ইস্রা তৌহিদের কথা থামিয়ে দেয়,
– "একটু সময় দে ভাইয়া... মানে, তৌহিদ। শুধু একটু সময়।"

তারা দু’জনে চুপচাপ বসে থাকে। সময় থেমে যায়। বাতাসে কেবল লিচু পাতার মৃদু শব্দ।

সেই মুহূর্তে ইস্রার মনে হচ্ছিল, কিছু অনুভবের ভাষা হয় না। কিছু ভালোবাসা সমাজের সংজ্ঞার বাইরে, কিন্তু তবুও সত্যি।













পর্ব – ২: ডায়েরির পাতায় জমে থাকা গল্প

রাতটা যেন আজ একটু বেশি নিঃসঙ্গ।
ফুপু বাড়ির সেই দক্ষিণ দিকের বারান্দার জানালার ধারে বসে ইস্রা চুপচাপ একটা পুরনো ডায়েরি খুলে বসেছে। ডায়েরিটার পাতায় পাতায় শুকিয়ে যাওয়া গন্ধ আছে—স্মৃতির গন্ধ। যেন পুরনো প্রেমের, না বলা কথার, চোখের ভাষার গন্ধ।

একটা পাতায় লেখা—

"১২ই আগস্ট ২০১৭
আজ তৌহিদ ভাইয়া হঠাৎ করে বলল, আমি নাকি বড় হলে নিশ্চয় অনেক ছেলেকে প্রেমে ফেলবো। বলেই হেসে দিল। আমি হেসেছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমার বুকের ভিতর কেমন করে উঠেছিল। আমি চাই না কেউ প্রেমে পড়ুক আমার, আমি চাই শুধু তৌহিদ ভাইয়া আমাকে একটু অন্যরকম ভাবে দেখুক।"

ইস্রা চুপচাপ সেই লেখা পড়তে থাকে। তখন সে ছিল ক্লাস নাইনে। কত সহজ ছিল অনুভব—আর কত কঠিন ছিল সেই অনুভবকে বোঝানো।

তখনো বুঝত না—একটা সম্পর্ক কীভাবে ধীরে ধীরে তার সীমারেখা অতিক্রম করে। তৌহিদ ভাইয়া তার বড় কাজিন, সমাজ বলবে ‘ভাই’—কিন্তু তার অনুভবগুলো কি সমাজের সংজ্ঞা মেনে চলে?


পরদিন সকালে, ইস্রা নাস্তার টেবিলে বসতেই তৌহিদ আসলো। কালকের বিকেলের পর যেন ওর চোখে একটু জড়তা, কিন্তু সেই চেনা উষ্ণতা আজও আছে। চা হাতে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো—
– "ডায়েরি লেখিস এখনো?"

ইস্রা একটু চমকে গেল।
– "তুই জানিস আমি ডায়েরি লিখি?"
– "তুই যে রাতে জানালার পাশে বসে ডায়েরি লিখতি, আমি জানতাম সব সময়। মাঝে মাঝে তোদের ঘরের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবতাম—এই মেয়ে জানে না, সে কার জন্য লিখছে, আর সেই মানুষটা কতটা বোকার মতো চুপ করে থাকছে।"

এই প্রথমবার ইস্রার চোখে পানি চলে আসে—না দুঃখে, না আনন্দে।
কেবল একটা স্বস্তির অশ্রু। এতদিনের নিরব ভালোবাসার স্বীকৃতি পেয়ে যেন হঠাৎ মন খালি হয়ে গেল।

– "তুই কিছু বলিসনি কখনো..."
– "ভয় পেয়েছিলাম। আমি যদি কিছু বলতাম আর তুই মুখ ফিরিয়ে নিতিস? তখন তোকে হারিয়ে ফেলতাম। তোর তো তখনও চোখে কলেজ, ক্যারিয়ার, বন্ধু... আমি ভাবতাম, সময় হলে বলবো। কিন্তু সময়টা বুঝে উঠতে পারিনি।"

কিছু সময় চুপচাপ কেটে গেল।

– "তুই এখন কারো সাথে... মানে... সম্পর্ক?"
তৌহিদের মুখে হালকা বিস্ময়।
– "ছিল একবার। তিন মাস। সে বিয়ে নিয়ে তাড়া দিচ্ছিল। আমি ভাবলাম, আমি তো এখনও অন্য কাউকে ভুলিনি... তাই শেষ করে দিলাম।"

ইস্রা কিছু বলে না। মনে মনে ভাবে, কত সহজে ছেলেরা এমন কথা বলে দেয়। অথচ মেয়েরা কত বছর বয়ে বেড়ায় সেই অস্বীকৃত অনুভব।


বিকেলে ইস্রা ছাদে উঠে গেল। আবার সেই উত্তর কোণ, সেই বাতাস, সেই বিকেল। কিন্তু আজ কিছু বদলে গেছে। আজ মনে হচ্ছে, সেই অতীত আর একতরফা নয়—তারও একটা পাল্টা সুর ছিল।

তৌহিদ পাশে এসে বসলো।
– "তুই কী ভেবেছিস আমার কথার উত্তর নিয়ে?"

– "আমি জানি না, তৌহিদ। এতদিন যেটা ভাবতাম একতরফা, সেটা যদি সত্যি হয়, তবে আমার ভয় করছে। এই সম্পর্কটা সহজ না। মা-বাবা জানলে কেমন নেবে? মানুষ কী বলবে?"
– "মানুষ বলবে অনেক কিছু। তুই শুধু বল, তুই কী চাস। আমি সমাজকে নিয়ে ভাবি না। আমি তোকে নিয়ে ভাবি।"

ইস্রার চোখে আবার জল চলে আসে।

– "আমি চাই... আমি চাই তুই থাকিস। তবে কিছু সময় দে। আমার অনুভবগুলোকে নিজের মতো করে জায়গা দিতে দে। তুই এত বছর যে অনুভব নিয়ে থেকেছিস, আমিও বাঁচতে চাই তেমন করেই... একটু একটু করে..."

তৌহিদ ইস্রার দিকে তাকায়।
– "আমি থাকবো। তুই সময় নে। কিন্তু আমার অনুভব বদলাবে না, কখনো না।"


সেদিন রাতে ইস্রা আবার ডায়েরি খুলে লেখে—

"১১ই জুন, ২০২৫
তৌহিদ ভাইয়া বলেছে সে ভালোবাসে আমাকে।
আজ আমি আর ভয় পাচ্ছি না। শুধু চাই সময়—নিজেকে বোঝাতে, প্রস্তুত করতে।
ভালোবাসা তো গাছের মতো... সময় দিতে হয়... পানি দিতে হয়।
আজ থেকে আমি সেই পানি দেওয়া শুরু করলাম।"

Monday, June 9, 2025

ভালোবাসা ত্রিভুজ, দ্বিতীয় পর্ব

 দ্বিতীয় পর্ব ;




ভালোবাসা ত্রিভুজ




পর্ব ৮: মীমের অন্তরালে

সকালের কাঁচা বাতাসে ক্যাম্পাসটা শান্ত, কিন্তু মীমের মন উল্টো একঘেঁয়ে ঝড়ো। সে জানে, আর কোনোদিন আগের মতো থাকবে না তার জীবন। তামিমের বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব আর রাফির নিঃশব্দ ভালোবাসা—দুটি জায়গায় তার হৃদয় আটকে আছে।

শুনেছে বাবা-মায়ের কথা, বন্ধুদের কথা, নিজেদের ভবিষ্যৎ ভাবনার কথা, আর নিজের অন্তরে চলছে প্রশ্নের বন্যা—"আমি কী চাই?"

রুমের এক কোণে বসে সে তার ডায়েরিতে লিখছে—
“তিন মাস পরে তামিম যাবে বিদেশ। আমার কাঁধে অনেক দায়িত্ব, কিন্তু আমার মনটা ওর সাথে যেতে চায় না। আমার নিজের জীবন, নিজের পরিচয় এখনই খুঁজে নিতে হবে।”

দিনের পড়াশোনায় মন দিতে পারছে না মীম। ক্লাস শেষে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ পড়ে রাফির দিকে, যিনি একা বসে থাকে ছায়ার নিচে, বইয়ের পাতা ঘুরিয়ে। রাফির চোখে আজ যেন কিছু অজানা ব্যথা লুকিয়ে।

মীমের মনের মধ্যে একটা কথা বারবার বাজে—“তুই কি সত্যিই রাফির প্রতি সে ভালোবাসা অনুভব করিস? বা তামিমের সাহসী প্রস্তাবে স্বপ্ন দেখিস?”

এক বিকেলে সে চলে যায় একা লেকের ধারে, যেখানে প্রথমবার তামিম তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। সেখানে বসে সে ঝড়ের মতো বয়ে যাওয়া ভাবনা গুলোকে অনুভব করে। কাঁদতে কাঁদতে সে বুঝতে পারে, ভালবাসা শুধু পছন্দের কথা নয়, সাহসের নামও।

ফিরে এসে সে ঠিক করে,
“আমি ওদের দুজনকেই চিনি, তবে নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

সেই সন্ধ্যায় মীম ফোন করে রাফিকে,
— “আমার সঙ্গে একটু কথা বলবি?”

রাফির বুক ধক করে ওঠে। মনে হয়, আজ সবকিছু বদলে যাবে।


ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ৯: মুখোমুখি

লেকের ধারে, সন্ধ্যার হালকা রঙের আকাশের নিচে বসে রাফি ও মীম দুজনেই একটু সঙ্কোচে, কিন্তু মনটা অদ্ভুত করে জোরালো।

রাফি প্রথমে বলল,
— “মীম, আমি জানি আমি কিছুদিন ধরেই তোকে বোঝাতে পারিনি। আমি শুধু চাই, তুমি বুঝতে পারো, আমি তোমাকে কতটা গভীরভাবে ভালোবাসি।”

মীম নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
— “রাফি, আমি সবসময়ই তোমার প্রতি অনেক সম্মান ও ভালোবাসা অনুভব করেছি। কিন্তু আমার মনে একটা দ্বিধা আছে। আমি তোকে বন্ধুত্বের বাইরে দেখতে পারিনি, এখনও পারছি না।”

রাফির চোখে একটু দুঃখ ফুটে ওঠে,
— “আমি জানি, এটা সহজ না। ভালোবাসা শুধু একটা অনুভূতি নয়, এটা সময় নেয়, বিশ্বাস নেয়। আমি অপেক্ষা করতে পারি। তবে আমি চাই তুমি নিজের মনের কথা জানো।”

মীম কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর বলল,
— “আমার জীবনে এখন একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তামিমের প্রস্তাব আমাকে অনেক ভাবাচ্ছে। আমি জানি না, আমি কী চাই।”

রাফি মাথা নাড়িয়ে বলল,
— “আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব, মীম। তুমি যাই করো, আমি তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করব।”

তাদের কথোপকথন যেন একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
যেখানে অপেক্ষা আর বিশ্বাসের মাঝেই শুরু হয় ভালোবাসার নতুন খুঁটিনাটি গড়া।











ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ১০: মুখ খোলা কথা

রাতের নিরিবিলি ঘরে, মীম আর তামিম দু’জনে একসঙ্গে বসে ছিল। বাতাস হালকা বইছে জানালা দিয়ে, আর আকাশের তারা যেন তাদের কথোপকথনের মৃদু সাক্ষী।

তামিম প্রথমেই বলল,
— “মীম, আমি জানি আমাদের মধ্যে কিছু জটিলতা আছে। আমি তোমাকে বিদেশে নিয়ে যেতে চাই, কিন্তু আমি চাই সেটা তোমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করুক।”

মীম কিছুক্ষণ চুপ ছিল। তারপর ধীরে বলল,
— “তামিম, আমি সত্যি তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারি, আর আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার মনের মধ্যে এখনো অনেক প্রশ্ন, অনেক দ্বন্দ্ব।”

তামিম হাসল,
— “আমি জানি, এটা সহজ নয়। কিন্তু আমি চাই, আমরা একসাথে সব কিছু মোকাবেলা করব। তুমি যদি চাই।”

মীম চোখে পানি নিয়ে বলে,
— “আমি ভয় পাচ্ছি, তামিম। ভয় পাচ্ছি, আমি হয়তো তোমাকে বা নিজেকে হতাশ করব।”

তামিম হাতে তার হাতটা নিল,
— “ভয় পেও না, মীম। আমি পাশে আছি, আমরা একসাথে পথ চলব। শুধু বলো, তুমি কি আমার পাশে থাকতে চাও?”

মীম ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
— “আমি চাই, তামিম। কিন্তু আমার সময় দরকার আমার হৃদয় ঠিকঠাক বুঝতে।”

তামিম হাসি দিয়ে বলল,
— “সময় আমি দিব, যতটা প্রয়োজন।”

সেই রাতে মীম বুঝতে পারল, ভালোবাসা শুধু অনুভূতির নাম নয়, ধৈর্যের নামও।











ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ১১: বোঝাপড়ার আলো

ক্যাম্পাসের ছায়ায় রাফি আর তামিম দেখা করল। তাদের দুজনের চোখে অদ্ভুত এক বুঝাপড়ার ছাপ ছিল।

তামিম বলল,
— “রাফি, আমি জানি আমরা তিনজনের মধ্যে অনেক কিছু ঝুলে আছে। তবে আমি চাই আমরা সবাই একে অপরকে সম্মান করি। মীমের জন্য যেটা ভাল, সেটাই চাই।”

রাফি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল,
— “আমি আগেও বলেছি, আমার জন্য মীমের সুখই সবচেয়ে বড়। আমরা বন্ধু হিসেবে থাকতে পারি, আর ওর সিদ্ধান্তের সম্মান জানাব।”

দুজনেই অনুভব করল, ভালোবাসার মাঝে বন্ধুত্বের গুরুত্ব কখনো কমে না। বরং এটাই শক্তির উৎস।

সেই দিন থেকে তারা মীমকে দেয় আরও বেশি স্বাধীনতা ও সময়।
মীম ধীরে ধীরে নিজের মনের ভিতর ঝড়কে সামলাতে শুরু করে।

এক সন্ধ্যায় মীমের কাছে দুই জনেরই থাকা তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়।


চলুন, পাঠিয়ে দেই ভালোবাসা ত্রিভুজ–এর পর্ব ১২, যেখানে মীম নিজের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে আর তার জীবন নতুন মোড় নেবে।


ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ১২: সিদ্ধান্তের মোড়

একটি হালকা ঝড়ের সন্ধ্যায়, মীম একাকী বসেছিল ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির ধারে।
তার মনের ভিতরে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল—রাফি, তামিম, তার নিজস্ব স্বপ্ন, তার নিজের অনুভূতি।

সে জানে, এবার আর সময় নেই ঝুলিয়ে রাখার। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সে ফোনে দুজনের সঙ্গেই কথা বলল।
রাফির সাথে বলল,
— “রাফি, তোমার ভালোবাসা আমি শ্রদ্ধা করি। তুমি আমার জন্য একটা বিশাল বন্ধু, আর আমি চাই ওরকমই থাকি।”

তারপর তামিমকে ফোন করে বলল,
— “তামিম, তোমার সাহস আর ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ। তোমার প্রস্তাব আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার, কিন্তু আমি এখনো নিজের পথে যেতে চাই।”

তাদের দুজনেই বুঝতে পারল মীম নিজের পথ খুঁজছে, এবং তাদের দুজনকেই মীমের সেই স্বাধীনতা দেওয়ার প্রয়োজন।

পরের দিন সকালে মীম ক্যাম্পাসে এসে জানাল,
— “আমি আমার জন্য একটা নতুন জীবন শুরু করতে চাই, যেখানে আমি নিজের স্বপ্নগুলো অনুসরণ করব।”

তামিম আর রাফি দুজনেই হাসিমুখে তার পাশে দাঁড়াল।

মীম বুঝল, ভালোবাসা কখনো বাধ্যবাধকতা নয়, বরং সমঝোতা আর শ্রদ্ধার নাম।


ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ১৩: নতুন সূচনা

মীম আজ এক নতুন মনোবল নিয়ে ক্যাম্পাসের রাস্তায় হাঁটছিল। তার চোখে স্বপ্নের দীপ্তি, আর হৃদয়ে নতুন উদ্দীপনা। সে জানত, নিজের জন্য পথ তৈরি করাই এখন তার প্রথম কাজ।

তার সামনে বিশাল সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে—নতুন মানুষ, নতুন চিন্তা, নতুন পরিকল্পনা।

তামিম ও রাফি দুজনেই এখন তার বন্ধু, যারা তাকে সমর্থন করছে। তাদের ভালোবাসা ও সম্মান মীমকে শক্তি দিচ্ছে।

কিন্তু আজকের মীম শুধুই তার নিজের জন্য বেঁচে থাকবে। সে বুঝেছিল, ভালোবাসা মানেই শুধু কারো কাছে নিজেকে উৎসর্গ করা নয়, নিজের প্রতি ভালো থাকা, নিজের স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নেওয়া।

তার হাতের মধ্যে আজ একটা খোলা খাতা, যেখানে সে লিখবে তার নতুন গল্পের প্রথম পাতা।




ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ১৪: স্বপ্ন ও বন্ধুত্ব

মীম আজ তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল। ক্যাম্পাসের ছোট্ট অফিসে সে নতুন একটা প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছিল। নিজেকে প্রমাণ করার একটা সুযোগ ছিল এটা তার কাছে।

তামিম ও রাফি দুজনেই পাশে ছিল।
তামিম বলল,
— “মীম, তুই যা করিস, আমি সবসময় তোর পাশে আছি।”

রাফিও হেসে বলল,
— “তোর শক্তি আর সাহস দেখে আমি গর্বিত।”

মীমের মনে সেই ভালোবাসার মিশ্রণটা এখন পূর্ণতায় রূপান্তরিত হচ্ছিল — ভালোবাসা শুধু প্রেম নয়, এটা সম্মান, বন্ধুত্ব, এবং পারস্পরিক বিশ্বাস।

একদিন সন্ধ্যায়, তিনজন একসঙ্গে লেকের ধারে বসে কথা বলছিল। তারা বুঝেছিল, জীবনের সব সম্পর্ক জটিল, কিন্তু ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব তাদের শক্তি।

মীম ভাবল, “যে স্বপ্নগুলো দেখেছি, তার জন্য লড়াই করব। আর যারা পাশে আছে, তাদেরকে কখনো ভুলব না।”










ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ১৫: নতুন দিগন্ত, নতুন সূচনা

সূর্যের প্রথম কিরণ ভোরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর ক্যাম্পাসের গাছপালা যেন জীবনের নতুন গান গাইছিল। তিন বন্ধু—মীম, রাফি আর তামিম—সকালবেলা লেকের ধারের বেঞ্চে বসে ছিল, মুখে অজানা এক শান্তি আর অন্তরে গাঢ় বিশ্বাস।

রাফি প্রথমে বলল,
— “আমি আজও মনে করি, ভালোবাসা একমাত্র অনুভূতি নয়, এটা একটা দায়িত্ব, একটা বোঝাপড়া। আমাদের তিনজনের এই সম্পর্কটা হয়তো সব সময় সহজ ছিল না, কিন্তু এই বন্ধুত্বের ভিতর থেকে আমরা এক নতুন শক্তি পেয়েছি।”

মীম তাকিয়ে রাফির দিকে বলল,
— “তুই বলছিস ঠিকই, রাফি। আমি শিখেছি ভালোবাসা মানে শুধু নিজের সুখ নয়, পারস্পরিক সম্মান আর সহমর্মিতা। আমি তোমাদের দুইজনের ভালোবাসা আর বন্ধুত্বেই নিজের নতুন জীবন গড়তে চাই।”

তামিমের চোখে মৃদু পানি জমে গেল, সে ধীরে বলল,
— “আমরা সবাই জানি, জীবনের পথে অনেক বাঁক আছে, কখনো আনন্দ, কখনো দুঃখ। কিন্তু সত্যিকারের বন্ধু আর ভালোবাসা থাকলে সবকিছু সম্ভব। মীম, তোমার এই সাহস আমাকে অনুপ্রাণিত করে।”

তারা তিনজন উঠে দাঁড়িয়ে একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল। যেন সেই স্পর্শেই ছিল তাদের জীবনের সমস্ত আশা, স্বপ্ন আর ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি।

মীম মনে মনে ভাবল,
“আজ থেকে শুরু আমার জীবনের নতুন অধ্যায়, যেখানে আমি আমার স্বপ্নগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে চাই। আর যারাই পাশে থাকবে, তাদের ভালোবাসা পাবে সব সময়।”

তারা তিনজন একসঙ্গে হাঁটতে লাগল, নতুন দিনের আলোয় ঘেরা এক পথ ধরে — যেখানে ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব ছিলো একসাথে, এক অপরিহার্য সাথী।

এইভাবে, তাদের জীবনের যাত্রা চলতে থাকবে নতুন দিগন্তে, যেখানে প্রতিটি দিন হবে নতুন সম্ভাবনার শুরু, নতুন গল্পের সূচনা।






ভালোবাসা ত্রিভুজ

গল্পের শহর ;





ভালোবাসা ত্রিভুজ



পর্ব ১: পরিচয়

ঢাকা শহরের কোলাহলে মিশে থাকা হাজারো মুখের ভিড়ে কিছু মুখ অদ্ভুতভাবে আমাদের জীবনে এসে স্থায়ী হয়ে যায়। যেমন রাফি আর তামিম—দুই বন্ধু, দুইটা বিপরীত চরিত্র, কিন্তু একে অপরের পরিপূরক।

রাফি জন্ম থেকেই একটু নীরব প্রকৃতির ছেলে। তার চোখে সব সময় একটা গম্ভীর, চিন্তিত অভিব্যক্তি খেলে বেড়াত। মুখে কম কথা, বইয়ের পৃষ্ঠায় বেশি সময়। ধানমন্ডির এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সে। মা-বাবা দুজনেই শিক্ষক, তাই রাফির বেড়ে ওঠা হয়েছিল কঠোর শাসনের ছায়ায়।

অন্যদিকে তামিম যেন এক ঝড়। সে যেখানে যায়, আড্ডা জমে, হাসি ছড়িয়ে পড়ে। উচ্চবিত্ত ঘরের একমাত্র ছেলে। গুলশানের এক আধুনিক পরিবারে বড় হওয়া তামিমের জন্য জীবনটা বরাবরই একটু সহজ ছিল। কিন্তু তার ভেতরে একটা গভীরতা ছিল, যেটা সে খুব সহজে প্রকাশ করত না।

দুই বন্ধু একসাথে স্কুলে পড়ে না, তবে কলেজ জীবন থেকে তাদের বন্ধুত্বের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে ভর্তি পরীক্ষায় টিকেও তারা একই বিভাগে চলে আসে—বাংলা বিভাগ। একাডেমিক ক্যাম্পাসের ঘাসে বসে বিকেল কাটানো, টিএসসির চায়ের কাপ, মিলন চত্বরের নিরবতা—সব জায়গাতেই তাদের জোড়া দেখা যেত।

তবে এই গল্পের বাঁক নেয় যেদিন মীম তাদের জীবনে প্রবেশ করে।

মীম প্রথমদিন ক্লাসে এসেই যেন একটা হালকা ঝড় বইয়ে দেয়। শাড়ি পরা মেয়েটার চোখে অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস ছিল। তার উচ্চারণে, চালচলনে ছিল পরিশীলিত একটা আভিজাত্য, কিন্তু মনটা ছিল একদম সহজ, সহজাত, বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশে যাওয়ার মতো উষ্ণ।

তামিম প্রথম থেকেই ওকে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

—"দোস্ত, নতুন মেয়েটা দেখলি? নামটা কী যেন... মীম না?"
রাফি হালকা হেসে বলে, "হুম, শুনলাম। গাজীপুর থেকে এসেছে, হলে থাকে।"

—"বাহ! গাজীপুর তো দূর... এমন মেয়ে হলে থেকে পড়ে মানে সিরিয়াস টাইপ মনে হয়।"

রাফি কিছু না বলে একটা বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ রাখে। কিন্তু তার মনও ঠিক তখনই মীম নামটা গেঁথে নিচ্ছে নিজের ভেতরে।

কিছুদিনের মধ্যেই পরিচয় হয়। ক্লাসের একটা গ্রুপ প্রেজেন্টেশনে রাফি, তামিম আর মীম এক গ্রুপে পড়ে যায়। কাজ করতে করতে, কথা বলতে বলতে একটা সেতু তৈরি হয়—রাফির নীরবতা, তামিমের প্রাণখোলা আড্ডা আর মীমের মাঝারি মেজাজ মিলে এক অদ্ভুত সঙ্গতি তৈরি করে।

প্রেজেন্টেশনের দিন, মীম যখন পুরো ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে তার অংশ উপস্থাপন করে, তখন রাফির মনে হয়—এই মেয়েটার মধ্যে কিছু আছে। এমন কিছু, যেটা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না... কেবল অনুভব করা যায়।

সেদিন বিকেলে তামিম বলে,
—"দোস্ত, মেয়েটা অনেক স্মার্ট, না?"
রাফি মাথা নাড়ায়, ধীরে বলে, "হুম, খুব আত্মবিশ্বাসী।"
তামিম হেসে বলে, "আর সুন্দরও, না?"
রাফি এবার কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে সামনের লাল গোধূলির দিকে।

মীম তখনো জানে না—তার জীবনের গল্প লিখে ফেলছে দুটো হৃদয়। দুটো বন্ধু, যারা একদিন হয়তো একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াবে ভালোবাসার এক অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে।


ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ২: বন্ধুত্বের রঙ

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ছয় মাস এক অদ্ভুত গতিতে কেটে যাচ্ছিল। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়াল, গ্রুপ প্রেজেন্টেশন—সবকিছুর মধ্যেও সময় যেন উড়ে চলেছিল রঙিন পাখির মতো।

এই সময়েই মীম, রাফি আর তামিম—তিনজনের বন্ধুত্ব এমন জায়গায় পৌঁছে গেল যেখানে তারা কেউ কাউকে ছাড়া ভাবতেই পারত না।

একদিন ক্লাস শেষে তারা তিনজন বসেছিল ক্যাম্পাসের পেছনের বটগাছটার নিচে। সন্ধ্যার আলো ফুরিয়ে যাচ্ছিল, পাখিরা ডানায় ভর করে বাড়ি ফিরছিল।

তামিম হাসতে হাসতে বলল,
—"এই মীম, তোর মনে হয় না, রাফি আসলে মোনালিসার আত্মীয়?"
মীম অবাক হয়ে তাকায়,
—"মানে?"
—"মানে রে বোকা, ওর মুখেও সেই একই রহস্যময় হাসি! কই হাসি? না হাসি?"

রাফি হালকা হাসে, কিছু না বলে। মীমও হেসে ফেলে।
—"তোর কথার জবাব নেই।"

তামিমের বলা কথাগুলো ছিল হালকা, মজার, কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল এক অদৃশ্য দখলের অনুভূতি। সে বুঝতে পারছিল, রাফির ভেতর কিছু একটা চলছে—যেটা মুখে বলছে না, কিন্তু চোখে টের পাওয়া যায়।

রাফি কিন্তু নিজেও সেটা স্বীকার করতে ভয় পায়। সে জানে, এই যে প্রতিদিন মীমের অপেক্ষায় থাকা, তার এক টুকরো হাসি দেখে মন ভালো হয়ে যাওয়া, তার চোখের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাওয়া—এসব কেবল বন্ধুত্ব নয়।

কিন্তু এই অনুভূতি নিয়ে সে কিছু বলতে পারে না।
সে ভয় পায়।
তামিমকে হারানোর ভয়, মীমকে হারানোর ভয়, নিজেকে হারানোর ভয়।

অন্যদিকে তামিম ঠিক করেছিল একদিন না একদিন মীমকে সে বলবেই তার মনের কথা।
তার ধারণা ছিল—সে যেমন প্রাণবন্ত, যেমন আত্মবিশ্বাসী—মীম তার সাথেই মানানসই। রাফিকে সে কখনোই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে না, বরং ভাবে—ও তো এমনিই, কারো প্রেমে পড়বে না।

একদিন একটা বৃষ্টির বিকেলে, মীম হঠাৎ রাফিকে জিজ্ঞেস করল,
—"রাফি, তুই কীভাবে এত চুপচাপ থাকতে পারিস?"
রাফি কাঁধ ঝাঁকায়,
—"সবার স্বভাব আলাদা। আমি বেশি বলার মানুষ না।"

মীম একটু হাসে। তার চোখে একটা মৃদু কৌতূহল,
—"তোর চোখে অনেক কিছু জমে থাকে রে... কখনো ভাবিস মুখে বলবি?"
রাফি চমকে যায়।
সে ভাবে, ‘ও কী বুঝে ফেলল?’

কিন্তু না, মীম কিছুই বোঝে না। সে নির্দ্বিধায় বলে,
—"তুই আমাদের মাঝে সবচেয়ে পরিণত, জানিস?"

রাফির ঠোঁটে তখন সেই মোনালিসার মতো হাসি খেলে যায়।
চুপচাপ, নীরব, কিন্তু গভীর।

সেদিন থেকেই বন্ধুত্বের রঙে অন্য এক আবেশ মিশে যেতে শুরু করে।
যেখানে রঙ কেবল লাল, নীল, হলুদ না—সেখানে আবেগ, আকর্ষণ, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগ একসাথে আঁকা হতে থাকে।

তবে এই রঙগুলো সবাই দেখে না। কেউ দেখে ভেতর দিয়ে, কেউ বুঝে চোখ দিয়ে, আর কেউ থাকে অন্ধকারে—চোখে আলো থাকলেও হৃদয়ের জানালা বন্ধ রেখে।










ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ৩: না বলা ভালোবাসা

রাফি জানে, সে মীমকে ভালোবেসে ফেলেছে।
কিন্তু সে এটাও জানে—এই ভালোবাসার কথা বলা মানেই একটা বন্ধুত্বের সমাপ্তি ডেকে আনা, একটা সম্পর্কের ভারসাম্য ভেঙে ফেলা, এমন কিছু দাবি করা—যেটা তার প্রাপ্য নয়।

প্রতিদিন মীমকে দেখে তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত ঢেউ ওঠে।
মীমের হাসি, তার সরল প্রশ্ন, হঠাৎ হঠাৎ হাত ছুঁয়ে বলা “রাফি, তুই তো সব জানিস”—সবকিছু যেন রাফির হৃদয়ের গোপন কোনায় গেঁথে থাকে।

কিন্তু রাফি জানে, মীম ওকে "বিশেষভাবে" ভাবে না।

সে তামিমের মত সাহসী না, উচ্চারণে সাবলীল না, গলার স্বরে আস্থা নেই।
সে বিশ্বাস করে, “ভালোবাসা যদি নিঃশব্দে থাকে, তবে সেটা আর কাউকে কষ্টও দেয় না।”

একদিন টিএসসির চায়ের দোকানে তামিম ও মীম কিছুটা দূরে বসে গল্প করছিল। রাফি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা চায়ের কাপ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তার চোখ মীমের মুখে আটকে আছে—এক মুহূর্তের জন্য হলেও, সে যেন চায় সময় থেমে যাক।

—"রাফি, চা খাবি না?" তামিম ডেকে তোলে তাকে বাস্তবতায়।
সে একটু চমকে উঠে হাসে, "হ্যাঁ, হ্যাঁ খাচ্ছি তো।"

তামিম ওর পাশে এসে দাঁড়ায়।
—"দোস্ত, একটা কথা বলি?"
রাফি তাকায় ওর দিকে।
—"বল।"
—"আমি ঠিক করেছি, মীমকে বলব আমি ওকে পছন্দ করি।"

সেই মুহূর্তে রাফির ভেতরের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায়।
যেন কেউ তার বুকের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে, নিঃশব্দে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে।
সে ঠোঁট ভিজিয়ে শান্ত গলায় বলে,
—"তুই নিশ্চিত?"
—"হ্যাঁ। এতদিন তো ভাবছিলাম, এখন মনে হচ্ছে আর দেরি করা ঠিক হবে না।"

রাফি মাথা নাড়ায়।
—"ঠিক আছে। বল।"

তামিম আনন্দে বলে,
—"তুই পাশে থাকবি তো, রে? আমি জানি তুই ছাড়া আমার কোনো পরিকল্পনাই জমে না।"

রাফি কৃত্রিম হাসিতে মুখ ঢাকে।
—"আমি তো থাকবই।"

মনে মনে রাফি ভাবে,
“মনের কথা বলার অধিকার কি আমার ছিল না? নাকি তোর জন্য আমি সব ছেড়ে দিতেই শিখেছি, তামিম?”

পরদিন ক্লাস শেষে তামিম আর মীমকে ক্যাম্পাসে হাঁটতে দেখে রাফি একা ফিরে যায়। সে জানে, আজ তামিম বলবে তার মনের কথা। আজ হয়তো অনেক কিছু বদলে যাবে।

হোস্টেলের রুমে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ে রাফি। চোখ বন্ধ করে।
কিন্তু মনের দরজায় একটানা ধাক্কা দিচ্ছে মীমের কণ্ঠস্বর, হাসি, চোখ... আর তামিমের বলা সেই কথাগুলো।

রাফি মনে মনে বলে,
"আমি তোকে ভালোবাসি, মীম। কিন্তু তুই তা কখনো জানবি না। কারণ আমার ভালোবাসা কেবল অনুভবের জন্য, দাবি করার জন্য নয়।"

এই পর্বে, প্রথমবার রাফি উপলব্ধি করে—ভালোবাসা মানেই পাওয়ার খেলা নয়। কিছু ভালোবাসা শুধু বুকের ভেতর থাকে, নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থে।



ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ৪: তামিমের স্বীকারোক্তি

আকাশ সেদিন ছিল মেঘলা। ধোঁয়াশা, ভেজা বাতাস, আর বিকেলের নরম রোদ মিলে একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছিল পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে।

তামিম সেদিন নিজেকে যেন অন্যরকম লাগছিল। সে আয়নায় তাকিয়ে একাধিকবার নিজের চুল ঠিক করেছিল, জুতোটা মুছেছিল, এমনকি নতুন পারফিউমও দিয়েছে—যেটা সে সাধারণত ব্যবহার করে না। তার মনে হচ্ছিল, এই দিনটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

মীমকে সে ডেকেছিল ছুটির পর ক্যাম্পাসের পেছনের লেকে। ওরা প্রায়ই সেখানে বসে গল্প করত, তাই আলাদা করে কিছু বোঝার সুযোগ ছিল না।

মীম আসতেই তামিম একটু সঙ্কোচে পড়ে গেল। সাধারণত সে খুব সাবলীল, কিন্তু আজ বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল। মীম সাদা ওড়না মাথায় দিয়েছে, চোখে হালকা কাজল—তামিম যেন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই চায়।

—"তামিম, বল। এমন গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে বসে আছিস কেন?"
তামিম একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয়।
—"মীম, আজ আমি তোকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। খুব সিরিয়াস কথা।"

মীম একটু থমকে যায়। তার চোখে একটা কৌতূহল দেখা দেয়।

—"তুই তো জানিস, আমি সাধারণত যা ভাবি, সেটা বলেই ফেলি। কিন্তু এই কথা অনেকদিন ধরে মনে লুকিয়ে রেখেছি।
আমি তোকে পছন্দ করি, মীম। না না… এই পছন্দটা বন্ধু হিসেবে না। অন্যরকম।
আমি তোকে ভালোবাসি। খুব গভীরভাবে।
তুই আমার জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষ হতে পারিস, যদি তুই চাস।"

তামিম বলেই ফেলে সবকিছু। চোখে ছিল একরাশ বিশ্বাস, ঠোঁটে হালকা কাঁপুনি।

মীম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। তারপর ধীরে বলে,
—"তামিম, আমি তোকে অসম্ভব পছন্দ করি।
তোর হাসি, তোর বন্ধুত্ব, তোর প্রাণবন্ততা… সবকিছুই।
কিন্তু… আমি আসলে এখনও জানি না আমি তোকে ঠিক সেইভাবে ভালোবাসি কিনা।
আমি কনফিউজড, তামিম।
তুই তো জানিস, সম্পর্ক মানেই শুধু ভালো লাগা না—আরো অনেক কিছু লাগে, একধরনের মানসিক প্রস্তুতি। আমি কি সেই জায়গায় আছি, সেটা নিজেই জানি না এখনো।"

তামিম চুপচাপ শুনে যায়। মীম কোনো "না" বলে না, কিন্তু কোনো "হ্যাঁ"-ও না।

তামিম চেষ্টা করে হেসে বলতে,
—"আমি তোর উত্তর চাই এখনই না, মীম। তুই সময় নিয়ে ভাব। আমি অপেক্ষা করব।"

মীম মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।

সেদিন বাসায় ফেরার পথে তামিমের মনের ভেতর ছিল এক অদ্ভুত খালি ভাব। সে জানে না, মীম সময় নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে, কিন্তু সে এই প্রথম বুঝতে পারে—ভালোবাসা অনেক সময় উত্তরের চেয়েও প্রশ্নে বেশি ঘনীভূত হয়।

তামিম জানে না, ঠিক এই মুহূর্তে রাফি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির কোনায় বসে, বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে কী যেন পড়ার চেষ্টা করছে, অথচ তার চোখের পাতার নিচে আটকে আছে একটা নাম—মীম

আর মনের গহীনে একটা প্রশ্ন—
“সে কি ওকে হ্যাঁ বলবে?”










ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ৫: মীমের দ্বন্দ্ব

রাতে হলে ফিরে মীম জানালার পাশে বসে ছিল। জানালার ওপাশে আধো আলো-আঁধারিতে দেখা যাচ্ছিল ক্যাম্পাসের ছায়াময় গাছপালা। বৃষ্টির পরের সন্ধ্যায় বাতাসে একটা ঠাণ্ডা সতেজতা। কিন্তু মীমের মন যেন ভারী হয়ে আছে।

তামিমের প্রস্তাবটা হঠাৎ করে নয়, কিন্তু অপ্রস্তুতভাবে এসেছিল তার কাছে।

তামিম তাকে ভালোবাসে—এইটা সে বুঝেছিল আগেই। কিন্তু তামিম বলার পর ব্যাপারটা আরও বাস্তব হয়ে উঠল। কোনো কল্পনা বা ইঙ্গিত নয়, এবার সত্যিই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সে ভাবছিল,
“তামিমকে আমি পছন্দ করি। ও দারুণ বন্ধু, যত্ন করে, হাসাতে জানে, পাশে থাকে। কিন্তু ভালোবাসি? জানি না। আমি কেন এত দ্বিধায়?”

তার মনের কোণে বারবার ভেসে উঠছে রাফির মুখ।
রাফির নিঃশব্দ হাসি, চোখের গভীর দৃষ্টি, কথা না বললেও বলা হয়ে যাওয়া অনুভবগুলো।

একদিন, মীম অসুস্থ হয়ে গেলে রাফিই প্রথম হলের সামনে গিয়ে তার জন্য ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিছু বলেনি, কেবল বলেছিল,
—"ওষুধটা সময়মতো খেয়ে নিস।"

সেই ছোট্ট, নির্ভরতার মতো শব্দগুলো আজও মীম ভুলতে পারেনি।

রাত বাড়ে। রুমমেটরা ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু মীমের চোখে ঘুম নেই।

তার মনে হচ্ছে, দুটো রাস্তা। একদিকে তামিম—উজ্জ্বল, সাহসী, ছায়ার মতো সঙ্গী হতে চাওয়া একটা মানুষ।
আর অন্যদিকে রাফি—নিরব, গভীর, অপ্রকাশিত কিন্তু অনুভূত এক ভালোবাসা।
যে ভালোবাসা হয়তো বলা হয়নি, কিন্তু অনুভব করা গেছে প্রতিটা আচরণে।

পরদিন ক্লাসে গিয়ে মীম রাফিকে দেখে।
রাফি ওকে দেখে চোখ সরিয়ে নেয়, কিন্তু মীম লক্ষ্য করে—আজ তার মুখটা যেন আরও গম্ভীর, চোখের নিচে হালকা ক্লান্তির ছাপ।

তামিমও হাসিখুশি থাকার ভান করছে। কিন্তু মীম জানে, ও অপেক্ষায় আছে।

বিরতির সময় তামিম বলে,
—"মীম, আজ একটু বাইরে যাবি? তোর উত্তরটা জানার ইচ্ছা হচ্ছে খুব।"

মীম হালকা হাসে,
—"তুই আমাকে আরেকটু সময় দিবি? আমার দরকার…"

তামিম চুপ হয়ে যায়। তার চোখে একটু হতাশার ছায়া।
সে মাথা নাড়ে,
—"ঠিক আছে। সময় নে।"

রাফি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শুনে ফেলে কথাগুলো। সে কিছু বলে না, কিন্তু একটা চাপা স্বস্তি যেন বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে।

তবে মীম নিজেও জানে না—সে কী চায়।
সে জানে না, ভালোবাসা কি সাহসিকতায় জন্ম নেয়, নাকি নীরবতার গভীরতায়?

সেই রাতে ডায়েরির পাতায় সে লিখে ফেলে,
“তামিম আমাকে ভালোবাসে।
রাফি আমাকে বোঝে।
আমি কী চায়? আমি কার কাছে নিজের সবচেয়ে সত্যিকারের রূপটা দেখাতে পারি?”

তার উত্তর এখনো সে খুঁজে পায়নি।
কিন্তু সে জানে—এই প্রশ্নটার উত্তর একদিন না একদিন তাকে দিতেই হবে।










ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ৬: অজানার প্রস্তাব

পর্বের শুরুতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ও বন্ধুত্বের মাঝে দিন গুলো দ্রুত কেটে যাচ্ছে। কিন্তু রাফির মন যেন দিন দিন ভারাক্রান্ত হচ্ছে। সে মুখে হাসি রাখলেও ভিতরে লুকিয়ে আছে এক অজানা দুঃখ।

একদিন সন্ধ্যায়, ক্লাস শেষে তামিম মীমকে ডেকে বলে,
— “মীম, আমি একটা কথা বলতে চাই, যেটা হয়তো আমাদের জীবনের জন্য খুব বড় হতে পারে।”

মীম কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
— “কি কথা, তামিম? বল তো।”

তামিম এক গভীর শ্বাস নেয়,
— “আমার প্যারেন্টস অনেকদিন ধরেই চাচ্ছে আমি আমার ক্যারিয়ার বাড়ানোর জন্য দেশের বাইরে যাই। একটা সুযোগ এসেছে, আমাকে বিদেশে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে পাঠানোর জন্য। আমি যাচ্ছি বিদেশে।”

মীম চোখ বড় করে চেয়ে থাকে।
— “তুই? বিদেশে? কতদিন? কবে যাবিস?”

— “৬ মাসের জন্য। তবে… ওখানে গিয়ে আমি চাই তুই আমার সাথে থাকিস। আমার সাথে যদি তুই একসাথে যাও, তাহলে সেটা আমার জন্য অনেক বড় সাহসের কাজ হবে।”

মীম হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
— “আমি? আমার কী হবে? আমি তো...?”

তামিম মাথা নাড়িয়ে হাসে,
— “আমি জানি তুই পড়াশোনায় ভালো করিস, কিন্তু আমার চাই আমি ওখানে থাকতে চাই তোমাকে। আমি চাই তুমি আমার পাশে থাকিস, আমরা একসাথে নতুন একটা জীবন শুরু করি।”

এই কথা শুনে মীমের মনে ভাঙা ঘর যেন একটু ধীরে ধীরে গেঁথে যায়। তার মাথায় একের পর এক প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। রাফি? রাফির প্রতি তার মনের আবেগ? এতদিনের বন্ধুত্বের কি হবে?

রাফি দূর থেকে দেখে যায় মীম ও তামিমের এই আলাপ। তার বুকের ভেতর ঢেউ উঠে, আর সে বুঝতে পারে সে আর একেবারে চুপ থাকতে পারবে না।

সেদিন রাতেই রাফি সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার মনের কথাগুলো মীমকে জানাবে, আর সে চাইবে তার ভালোবাসা তার জীবনে নতুন আলো নিয়ে আসুক—চাইলে না চাইলেও।


চলুন, এখনই চলি ভালোবাসা ত্রিভুজ এর পর্ব ৭ এ — যেখানে রাফি শেষমেষ নিজের মনের কথা মীমকে খুলে বলবে, আর তামিমের প্রস্তাব নিয়ে মীমের ভাবনার দোলাচল আরও গভীর হবে।


ভালোবাসা ত্রিভুজ

পর্ব ৭: সত্যের মুখোমুখি

পরদিন বিকেলে, ক্যাম্পাসের শীতল ছায়ায় বসে রাফি একটা সাহসের নিঃশ্বাস নিয়ে মীমের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার হাতে এক কাপ চা, মুখে অস্থির একটা হাসি। মীম চোখ বড় করে তাকায়, বুঝতে পারে—আজ কিছু আলাদা হতে চলেছে।

রাফি বলল,
— "মীম, একটা কথা অনেকদিন ধরে আমার মুখে আসতে চাচ্ছিলো, কিন্তু সাহস হয়নি। এখন আর আরাম লাগে না সেটা লুকিয়ে রাখতে।"

মীম চুপ করে রাফির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মন এখনো তামিমের কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু রাফির কথা শোনার আগ্রহও কম নেই।

রাফি আবার বলল,
— "আমি তোকে ভালোবাসি, মীম। আমার ভালোবাসাটা নিঃশব্দ, চুপচাপ, কিন্তু সত্য। আমি জানি তুই হয়তো আমাকে ওইভাবে ভাবিস না, কিন্তু আমার জীবনে তুই একটা আলোর মতো—যে আলো ছুঁয়ে যায় আমার অন্ধকার মনে।"

মীম হঠাৎ বুকে একটা অজানা অনুভূতি অনুভব করল—আবেগের ঘূর্ণি, কষ্ট আর অদ্ভুত এক কোমলতার মিশ্রণ। সে চুপচাপ রাফির কথা শুনে, কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু শব্দ বের হলো না।

তখনই তামিমের বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব আবার তার মনে জেগে উঠে।
কী করবে সে? কার দিকে তার মন যাবে? রাফির নিঃশব্দ ভালোবাসা নাকি তামিমের সাহসী প্রস্তাব?

মীম গা ঢাকা দিয়ে বলতে চায়, "আমাকে সময় দাও।"

রাফির চোখে কিছুটা আশার ঝিলিক দেখতে পেল সে।

সেদিন থেকে মীমের মন জেগে ওঠে নতুন করে—ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর জীবনের জটিলতাগুলোকে নিয়ে। সে বুঝতে শুরু করে, ভালোবাসা কোনো সরল গল্প নয়, বরং সেটা নানা রঙে রঙিন এক মিশ্রণ।


দ্বিতীয় পর্ব দেখতে লিংকে ক্লিক করুন 


https://supervehiclesss.blogspot.com/2025/06/blog-post_96.html


📖





Saturday, June 7, 2025

📖 উপন্যাস: চিঠির ভাঁজে প্রেম

 গল্পের শহর ;




📖 উপন্যাস: চিঠির ভাঁজে প্রেম






📖 উপন্যাস: চিঠির ভাঁজে প্রেম

অধ্যায় ১: চোখের ভাষা, শব্দের চিঠি

🕰️ সময়: ২০১৪ সালের শরৎকাল

নামমাত্র রোদ, হালকা বাতাস, আর গাছের পাতাগুলো ঝরে ঝরে পড়ছে ঢাকার এক পুরনো কলেজ ক্যাম্পাসে। বইয়ের গন্ধ, চায়ের কাপে ভাসা সুগন্ধি ধোঁয়া, আর লাইব্রেরির পাশের বেঞ্চগুলোয় বসা কিছু মুখ—সব মিলিয়ে একটা কবিতার মতো দুপুর।

সেই কলেজেরই একজন ছাত্রী—মেঘমালা
চোখে ভারি চশমা, পরনে সাদা-কালো কুর্তি, হাতে হুমায়ুন আহমেদের পুরনো উপন্যাস। হাসে কম, কথা বলে কম, কিন্তু লেখে প্রচুর। প্রতিদিন নিয়ম করে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে, বই পড়ে, কবিতা লেখে, কেউ না জানে এমন অনেক কিছুর ভেতর বেঁচে থাকে।

অন্যদিকে, অয়ন রহমান—চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
সাহিত্য সম্পাদক, কলেজ ম্যাগাজিন ‘বিন্দু’র সম্পাদনায় যুক্ত। হাসিমুখ, কিন্তু চোখে গাঢ় গাম্ভীর্য।
সে মেঘমালাকে দেখেছে বহুবার—কিন্তু কোনোদিন সামনাসামনি কিছু বলেনি। হয়তো তার মনের কথা সে নিজের লেখাতেই বলত।

একদিন হঠাৎ করেই লাইব্রেরির মাঝখানে রাখা এক পুরনো রোদে পোড়া বইয়ের ভাঁজে, মেঘমালা পায় একটা ছোট্ট কাগজ—একটা চিঠি

*"তোমার চোখে গল্প আছে।
আমি সেই গল্পের প্রথম পাতায় দাঁড়িয়ে আছি,
যদি তুমি পড়তে দাও, আমি পড়ব শেষ পর্যন্ত।

— অয়ন"*

মেঘমালা কেঁপে ওঠে। তার ভিতরে কোথায় যেন হালকা ঢেউ ওঠে।
সে উত্তর দেয় না। কিন্তু পরদিন একই সময়ে লাইব্রেরিতে এসে ঠিক ওই জায়গায় বইটা রাখে আবার।









📮 অধ্যায় ২: নিরব চিঠির দিনে

সেই শুরু।
প্রতিদিন বিকেল চারটায় বইয়ের পৃষ্ঠায়, বইয়ের ফাঁকে, ম্যাগাজিনের নিচে—মেঘমালা পেতে থাকে অয়নের চিঠি। কখনো কবিতা, কখনো ছোট্ট মন্তব্য, কখনো অকারণে একটি শব্দ মাত্র।

একদিন একটি চিঠিতে অয়ন লিখল—

"আমি যদি হারিয়ে যাই?
যদি আর কোনোদিন চিঠি না দিই?
তুমি কি খুঁজবে আমাকে?"

মেঘমালা উত্তর দেয় নিজের ভেতরে। তারপর একদিন সাহস করে দিয়ে ফেলে তার প্রথম চিঠি।

"তোমার লেখাগুলো যেন নীরব গান।
আমি শুনি। কিন্তু ভয় পাই, যদি গান থেমে যায়।
তাই বলছি—থেমো না।"

তাদের ভালোবাসা কখনো ফোনে বলা হয়নি, ছবি তোলা হয়নি, বন্ধুরা জানত না।
তারা একে অপরের সঙ্গে দেখা করত লাইব্রেরির টেবিলের একপাশে—কিন্তু মুখে কোনো কথা হতো না।
তারা লিখত।
শুধু লিখত।


🌧️ অধ্যায় ৩: বৃষ্টির দিনে একটি খবর

একদিন, হঠাৎ করে বৃষ্টির দুপুরে মেঘমালা লাইব্রেরিতে এসে দেখে, টেবিল ফাঁকা। কোনো চিঠি নেই।
দিন যায়, রাত যায়, কোনো চিহ্ন নেই অয়নের।

তিন দিন পর, কলেজের নোটিশ বোর্ডে ঝুলে থাকা কাগজে এক ঘোষণা—
"অয়ন রহমান ফুলব্রাইট স্কলারশিপে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা ছাড়ছে।"

সে কাউকে বলেনি।
শুধু একটিই চিঠি রেখে গেছে লাইব্রেরির দেয়ালে গোঁজানো এক উপন্যাসের ভাঁজে।

*"তুমি যদি ভাবো, আমি হঠাৎ চলে গেলাম, তবে ঠিক ভাবো।
কারণ আমি জানতাম, এই বিদায় যদি বলি, তুমি হয়তো কান্না করবে।
তাই শুধু যেতে চাইলাম।

আমি তোমাকে কোনোদিন ছুঁইনি, কোনোদিন ‘ভালোবাসি’ বলিনি—
কিন্তু প্রতিটি চিঠিতে আমার আত্মা দিয়ে দিয়েছি।

আমি ফিরব।
যদি চিঠিগুলো পড়া থামাও না।"*










📚 অধ্যায় ৪: চিঠির ছায়া

চার বছর কেটে যায়।

মেঘমালা এখন কলেজে প্রভাষক।
তাকে ছাত্রছাত্রীরা খুব পছন্দ করে। কিন্তু কেউ জানে না, সে এখনো প্রতিদিন লাইব্রেরিতে যায়, প্রতিদিন সেই পুরনো উপন্যাসে আঙুল বুলিয়ে দেখে—নতুন চিঠি এল কিনা।

হঠাৎ একদিন, ডাকঘর থেকে একটি মোটা খাম আসে।
ভেতরে প্রায় ২০০টা চিঠি।

প্রতিটি চিঠি লেখা অয়নের হাতে।
প্রতিদিনের দিনলিপি। বিদেশের রাত, প্যারিসের বৃষ্টি, আমস্টারডামের নিঃসঙ্গতা, বরফে জমে থাকা তার মনের কথা।

*"আমি আজও জানি না তুমি কার সঙ্গে আছো। হয়তো আমার চিঠিগুলো অকারণ।

কিন্তু তুমি যদি একদিন আমার লেখা পড়ে কাঁদো, তাহলে জেনে নিও—
আমি সেই কান্নার একফোঁটা হতে চেয়েছিলাম চিরকাল।"*

চিঠির শেষে ঠিকানা লেখা।


🚂 অধ্যায় ৫: ফিরে দেখা

সেইদিনই ট্রেনে ওঠে মেঘমালা।
পেছনে কিছুই ফেলে আসে না।
হাতে পুরনো খাতা, আর বুকভরা ভালোবাসা।

অয়ন এখন এক গ্রাম শহরের কোণে একটা স্কুলে সাহিত্য পড়ায়।
হঠাৎ এক বিকেলে, স্কুলের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মেঘমালা।

অয়ন চমকে ওঠে। কিছু বলে না।

মেঘমালা চুপচাপ বলে,

“এই চার বছর, আমি প্রতিদিন লাইব্রেরিতে গিয়েছি।
তুমি ছিলে না, কিন্তু তোমার চিঠি ছিল।
আমি তো বলেছিলাম—থেমো না।

তুমি থামোওনি।
আর আমি ফিরে এসেছি।
এইবার একটা কথা বলো—চিঠি নয়, মুখে।”

অয়ন শুধু হাত ধরে, বলে—

“তুমি আমার প্রতিদিনের গল্প।
চিঠির ভাঁজে লুকানো ভালোবাসা এবার ছুঁয়ে নিতে চাই।
এখন থেকে প্রতিটি পৃষ্ঠা একসঙ্গে লিখব আমরা।”





📖 সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা

গল্পের সম্ভার ; 📖 সেই খামখেয়ালি ভালোবাসা ✦ ১ম পর্ব :  নতুন ঠিকানায়, নতুন গল্পে মেহরিন ক্লাস নাইনে নতুন ভর্তি হয়েছে শহরের বিখ্যাত ‘বিকাশ ব...